আজকে আমরা সিভিল ইঞ্জিনিয়ার ভাইদের জন্য নিয়ে এসেছি “ভূমিকম্প প্রতিরোধ সম্পন্ন বাড়ি”। আসা করি আপনাদের এই টপিক পছন্দ হবে। তো চলুন পড়া যাক:
ভূমিকম্প প্রতিরোধ সম্পন্ন বাড়ি
ভূমিকম্প হলেই সবাই চিন্তা করে “আমার বাড়িটা কি পরবর্তী ভুমিকম্পে টিকবে ? ” যেহেতু বিষয়টা আমার পেশায় পরে এবংবিদেশে কিছু (ডজন খানেকের বেশী) হাইরাইজ বিল্ডিং এর seismic ডিজাইন করার অভিজ্ঞতা আছে, এ বিষয়ে কিছু পরামর্শ দিতে চাই।
তবে পরামর্শ দেয়ার আগে একটা ডিসক্লেইম করে নিতে চাই। কেউ যেন কোন প্রফেশনাল স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া সরাসরি আমার উপদেশ প্রয়োগ করতে না যান।
কানাডার ইঞ্জিনিয়ারিং এথিক্স আর ল বলে, আমি কনসাল্টিং ফি নেই বা না নেই, কেউ যদি আমাকে দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার ভেবে আমার উপদেশ কাজে লাগিয়ে বিপদে পরে তবে সে আমাকে তার ক্ষতির জন্যে মামলা ঠুকে দিতে পারবে।
১. আমার মতে খুব সল্প প্রচেস্টায় এবং কম খরচেই ঢাকা শহর সহ অনেক শহরে পুরনো বিল্ডিংগুলোকে ভূমিকম্প প্রতিরোধ করে নেয়া যেতে পারে ।
২. সাধারনত উচু দালানগুলো কোন Professional ইঞ্জিনিয়ার দ্বারা ডিজাইন করা হয় । সমস্যা হল চার-পাচ তলা বাড়িগুলো যেগুলো মিস্ত্রীর উপর ভারসা করে বানিয়ে ফেলা হয়েছে । আমি এসব বিল্ডিংএর উপর মূলত জোর দিচ্ছি, কিন্তু এই আলোচনা আরো উচু দালানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য ।
৩. কিভাবে ভুমিকম্পের সাথে মোকাবেলা হয়: ভূমিকম্প বা ঘূর্ণি ঝর জনিত কারনে বিল্ডিং এ ধাক্কা লাগে (হরাইজন্টাল ফোর্স) । বাকি সবসময় বিল্ডিংশুধু মানুষ আর আসবাবপত্রের বোঝা টানে (ভার্টিক্যাল ফোর্স) । আপনি যদি দু’পা একসাথে করে দাড়িয়ে থাকেন তাহলে যে কেউ সামনে বা পিছন থেকে ধাক্কা দিয়ে আপনাকে সহজেই ফেলে দিতে পারবে।
এর সাথে তুলনা চলে একটা কলাম বা আড়াআড়ি দেয়াল যা ভুমিকম্পে কোন কাজে লাগবে না । কিন্তু আপনি যদি ঘুরে দাঁড়ান তাহলে আপনাকে পাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলা অত সহজ হবে না । এর সাথে তুলনা চলে ধাক্কার দিক বরাবর একটা দেয়াল যা ভুমিকম্পে খুব কার্যকরী।
এবার আপনি যদি পা দুটা ছড়িয়ে দেন আপনাকে পাশ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলানো আরো দূরহ হয়ে যাবে। এর সাথে তুলনা চলে লম্বা দেয়াল (ধাক্কার দিক বরাবর)। দেয়াল যত লম্বা, ভুমিকম্প রোধে তত শক্তিশালী। দুই কলামের মাঝে ক্রস ব্রেসিং নিশ্চই অনেকেই দেখেছেন – এটা দেয়ালের বিকল্প ।
৪. তাহলে ভূমিকম্প এবংঘূর্ণিঝর রোধে সবচেয়ে কার্যকরী হল কিছু দেয়াল – সেটা কনক্রিট বা ইটের বা ব্লক এর হতে পারে । একটা চার থেকে ছ তলা রেসিডেন্সিয়াল বিল্ডিং এর জন্য দুই দিকে ( বিল্ডিং এর দৈর্ঘ আর প্রস্ত বরাবর ) দুই সেট ছোট দেয়ালই যথেস্ট।
নেপালের ধংস চিত্রের মধ্যে অক্ষত দাড়িয়ে থাকা কিছু বিল্ডিংএর এক্সটার্নাল ভিউতে দুই ডিরেকশনে দেয়ালগুলো আমার দৃস্টি আকর্ষণ করেছে।বেশিরভাগ ক্ষেত্রে লিফট কোর আর সিড়িঘরের দেয়ালগুলোকে কাজে লাগালেই চলে।
যদি তা দিয়ে পরিপূর্ণ না হয়, আর্কিটেক্টের সাথে আলাপ করে কিছু বাড়তি দেয়াল নির্বাচন করা যায় যেটা নীচ থেকে উপর পর্যন্ত কন্টিনিউ করবে । দেয়ালের অবস্থান নির্ণয়ে মোটামুটি symmetry বজায় রাখতে হয় যাতে ভুমিকম্পের ধাক্কায় বিল্ডিং মোচর খেয়ে না যায় । আগেই বলেছি দেয়ালের বিকল্প হিসাবে স্টিলের ক্রস ব্রেসিংব্যবহার করা যায় যা আমার মতে repair এর ক্ষেত্রে খুব কাজের হবে ।
5. এখন কথা হল কিভাবে পুরনো বাড়ির শক্তি বাড়ানো যায় । হ্যাঁ, দেয়াল খোজতে হবে । যে কোন বিল্ডিং এ দেয়ালের অভাব নাই । কিন্তু বেশিরভাগই পার্টিশন দেয়াল – তাদেরকে কোন বোঝা টানার জন্যে বানানো হয়নি।
বীম, ফ্লোর বা কলামের সাথে তারা সেভাবে সংযুক্ত না বরং ইচ্ছে করে বীম বা ফ্লোর থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করা হয় যেন তাদের সংযোগস্থলে ক্র্যাক দেখা না দেয় ( aesthetic ব্যাপার)।
ইঞ্জিনিয়ারের কাজ হবে আপনার এই দেয়ালকে ভূমিকম্প প্রতিরোধ দেয়ালে পরিনত করা – ফ্লোর বা বীমের সাথে ভালভাবে সংযুক্ত করে দেয়া । মনে রাখতে হবে ভুমিকম্পের ধাক্কাটা আসবে ফ্লোর ধরেই।
আমার মতে সহজ কাজ হবে বিকল্প ক্রস ব্রেসিংব্যবহার করা । এই ক্ষেত্রে কিভাবে ব্রেসিংটা দেয়ালের ভিতর লুকানো যায় ( aesthetic ব্যাপার) সেটা বের করতে হবে ।
যদি সিড়ি ঘরের মত বাইরের হয়, তাহলে ক্রস ব্রেসিং লুকানোর প্রয়োজন নাও হতে পারে – অর্কিটেক্টের সহায়তা নিয়ে ক্রস ব্রেসিংএর সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা যেতে পারে যেন দেখতে সোভনিয় হয়।
দেয়ালের জোর বাড়ানোর সাথে সাথে তার ফাউন্ডেশনের জোরটাও হিসাব করে পরখ করে নেয়া ভাল । তবে অনেক ক্ষেত্রেই হয়তো আগের ফাউন্ডেশনই যথেস্ট হবে যদিনা গোঁড়ায় গলদ থাকে ।
৬. শেষ কথা – কে উদ্যোগ নিবে – সরকার, রাজউক, নাকি নিজে? আমার মনে হয় নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে প্রতিটা বাড়ির মালিক নিজেই উদ্যোগী হতে পারেন । তাদের সহায়তার জন্যে অনেক দক্ষ বুয়েটিয়ান স্ট্রাকচারাল ইঞ্জিনিয়ার বাংলাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ।
যাদের নিজের ফার্ম আছে তারা একটা নতুন সার্ভিস খুলতে পারেন – পুরনো বিল্ডিংএর ভূমিকম্প উপযোগী করে দেয়া – যেসব ফার্ম এই সেবায় নাম করবে, দেখা যাবে তাদের সার্টিফাই করা বাড়ির ভাড়াও হচ্ছে বেশী – তাই মালিক নিজে সেই বাড়িতে না থাকলেও আগ্রহী হবেন এই সেবা পেতে।
বুয়েট গবেষনা করতে পারে কিভাবে সল্প ব্যয়ে পুরনো বিল্ডিংগুলোর ভূমিকম্প প্রতিরোধ বাড়ানো যায় । শুনেছি এখন বুয়েটে ভূমিকম্প বিষয়ক গবেষনার জন্যে নূতন ইন্স্টিটিউট আছে ।
আশা করি আপনারা ভূমিকম্প প্রতিরোধ সম্পন্ন বাড়ি, টপিকটি বুঝতে পেরেছেন। যদি এই পোস্ট টি আপনার উপকারে আসে তা হলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।