শাসক হিসেবে ফিরোজ শাহ-র মূল্যায়ন : সুলতানির পতনে দায়িত্ব - আসল ব্যাখা

শাসক হিসেবে ফিরোজ শাহ-র মূল্যায়ন : সুলতানির পতনে দায়িত্ব: আসসালামু আলাইকুম ভাই ও বোনেরা আপনারা কেমন আছেন? আশা করি ভালো আছেন, আমিও আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি, আপনাদের স্বাগতম জানাচ্ছি লাখ পড়া মাইমুনা তে। আমার নাম মাইমুনা, আজকে আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আপনাদের বিভিন্ন জায়গায় লাগতে পারে। 

আমি জানি আপনারা “শাসক হিসেবে ফিরোজ শাহ-র মূল্যায়ন : সুলতানির পতনে দায়িত্ব” বিষয়ে ধারণা নিতে অনলাইনে খোজাখুঝি করছেন।আর আপনি এখন একদম সঠিক পোস্ট এ আছেন। এখানে আপনি এই বিষয়টি সম্পর্কে সব ভালো ভাবে জানতে পারবেন।

শাসক হিসেবে ফিরোজ শাহ-র মূল্যায়ন : সুলতানির পতনে দায়িত্ব
 

শাসক হিসেবে ফিরোজ শাহ-র মূল্যায়ন : সুলতানির পতনে দায়িত্ব

সুলতান হিসেবে ফিরোজ শাহ তুঘলকের মূল্যায়নে ঐতিহাসিকেরা একমত হতে পারেননি। সাধারণভাবে ভারত-ইতিহাসে ফিরোজ শাহ প্রজাহিতৈষী শাসক হিসেবে চিহ্নিত হন। কেউ কেউ আবেগপ্রবণতার বশে ফিরোজ শাহকে “সুলতানি যুগের আকবর” বলেও অভিহিত করেছেন। কিন্তু তাঁর চরিত্র ও কার্যাবলি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এই সকল বক্তব্যের সাথে একমত হওয়া যায়। না। তাঁর শাসন-নীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের কোনো চেষ্টা করা হয়নি। পরন্তু, মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থা ও সামাজিক সম্পর্কের নেতিবাচক দিকগুলিকে তিনি অজান্তে হলেও লালন-পালন করেছেন। মহম্মদ বিন্-তুঘলকের ভ্রান্ত নীতির ফলে সাম্রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়েছে—এই সত্য বারবার উচ্চারণ করলেও; সেই সকল সংশোধন করার নামে তিনি নতুনভাবে এবং নতুনরূপে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতাকেই জাগরিত করেছেন। অধ্যাপক ইউ. এন. দে লিখেছেন : "He was a typical product of his age, ambitious and shrewed enough to wear a mask of disinterestedness, capable of assuming false appearance of virtue and goodness...."

প্রাথমিকভাবে ফিরোজ শাহের স্বপক্ষেও কিছু কথা বলা যায়। দীর্ঘ ৩৭ বছর (১৩৫১-৮৮ খ্রিঃ) তিনি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন। এই দীর্ঘ সময়ে দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল। অভ্যন্তরীণ বা বহির্দেশীয় কোনো বৃহত্তর সংকট দ্বারা সুলতানি সাম্রাজ্য জর্জরিত হয়নি। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পরে তিনি এমন কিছু কাজ করেছিলেন, যা মানবতাবাদী শাসক হিসেবে তাঁকে প্রতিভাত করেছে। প্রজাদের ওপর থেকে করের গুরুভার তিনি অনেকটা লাঘব করেন। প্রায় চব্বিশ প্রকার উপকর ও উপশুল্ক বিলোপ করেন। সেচব্যবস্থার সম্প্রসারণের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করেন। আলাউদ্দিনের মতো দমন নীতি প্রয়োগ ছাড়াই খাদ্যের সরবরাহ নিয়মিত রাখেন এবং দ্রব্যমূল্যের হারও ন্যায্য থাকে। তাঁর আমলে দুর্ভিক্ষ বা অনাহারে মানুষকে জর্জরিত হতে হয় না। আফিফ ফিরোজ শাহ-র আর্থিক নীতির ভূয়সী প্রশংসা করে জনসাধারণের পার্থিব সমৃদ্ধিতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

কেউ কেউ মনে করেন, ফিরোজ শাহ রাজশক্তিকে একটি 'প্রজাকল্যাণকামী মিশন' বলে মনে করতেন। তাঁর কয়েকটি সিদ্ধান্তে মানবতাবাদী গুণের প্রকাশ লক্ষ্য করা কষ্টকর নয়। দীনদরিদ্র মানুষের সাহায্যার্থে, জ্ঞানীগুণী ব্যক্তিদের আর্থিক দুরবস্থা লাঘবের উদ্দেশ্যে, দরিদ্র পিতামাতার অবিবাহিতা কন্যার বিবাহ সম্পাদনের জন্য তিনি সরকারি অর্থমঞ্জুরের ব্যবস্থা করেন। বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের সুব্যবস্থার জন্যও তিনি স্থায়ী দপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষার প্রসার ও চিকিৎসার সুব্যবস্থার জন্যও তিনি নানা পরিকল্পনা নেন। গড়ে তোলেন একাধিক দাতব্য চিকিৎসালয় ও বিদ্যালয়। এই হিতবাদী চিন্তার কারণে কেউ কেউ তাঁর মধ্যে সম্রাট অশোকের ছায়া প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর চারিত্রিক উৎকর্ষতারও অভাব ছিল না। একাস্ত ধর্মনিষ্ঠ, প্রথম জীবনে রাজনৈতিক উচ্চাশাবিমুক্ত এই মানুষটি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্যানুরাগী ছিলেন। নিজেই রচনা করেছেন অতি মূল্যবান গ্রন্থ ‘ফুতুহ-ই-ফিরোজশাহি। অর্থ এবং উৎসাহ দিয়ে সাহিত্যচর্চায় অনুপ্রাণিত করেছেন অন্যদের। তাঁর উৎসাহে বহু সংস্কৃত গ্রন্থ ফারসিতে অনূদিত হয়েছে, সংকলিত হয়েছে অনুবাদ গ্রন্থ 'দালাইল-ই-ফিরোজশাহি'।

এই সকল গুণাবলির জন্য সমকালীন মুসলমান ইতিহাসকার বারাণী ও আফিফ ফিরোজ শাহ তুঘলকে একজন আদর্শ মুসলমান শাসক' বলে অভিহিত করেছেন। এঁরা ফিরোজের কাজের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতা, প্রজাকল্যাণ ও ক্ষমাশীলতার চূড়ান্ত প্রকাশ লক্ষ্য করেছেন। এঁদের বর্ণনায় আপ্লুত হয়ে হেন্দ্রী ইলিয়ট, এল্‌ফিনস্টোন প্রমুখ ফিরোজের সাথে মুঘল সম্রাট আকবরের তুলনা করে ফিরোজকে ‘সুলতানি যুগের আকবর' বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ভি. স্মিথ, ঈশ্বরীপ্রসাদ, ড. মজুমদার, ডি. আর শর্মা প্রমুখ ইতিহাস এই তুলনার তীব্র বিরোধিতা করেছেন। বস্তুত, আকবরের প্রতিভা, প্রজ্ঞা, সাফল্য ইত্যাদির পাশে ফিরোজ শাহ তুঘলকের কার্যাবলিকে অত্যন্ত নিষ্প্রভ বলেই মনে হয়। আকবর ছিলেন সুযোদ্ধা, সুসংগঠক, একান্তভাবে ধর্মনিরপেক্ষ, প্রকৃত অর্থে ভারতের প্রথম জাতীয় সম্রাট। মুঘল প্রশাসনকে তিনি দিয়েছিলেন একটি সুনির্দিষ্ট ধাঁচ, যাকে ইস্পাত-কাঠামো' বলে অভিহিত করা হয়। ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং নানা ভাষা, নানা ধর্মের লোককে ঐক্যবন্ধনে আবদ্ধ করে তিনি ‘জাতীয় রাষ্ট্র’ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন। আকবরের ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল আদর্শভিত্তিক, প্রয়োজনভিত্তিক নয়। একাধিক মৌলিক নীতি রূপায়ণের দ্বারা তিনি একটি সুন্দর ও দৃঢ় প্রশাসনিক পরিকাঠামো গড়ে তুলেছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি রেখে গিয়েছিলেন একটি দৃঢ় ও ঐক্যবদ্ধ ভারতসাম্রাজ্য। আকবরের এই বহুমুখী প্রতিভা ও গুণাবলির সাথে ফিরোজ শাহের কৃতিত্বের তুলনাকে ঐতিহাসিক স্মিথ এক ‘অবাস্তব চেষ্টা’ বলে মনে করেন। ড. মজুমদারের ভাষায় : এই তুলনা এক 'জঘন্য' প্রচেষ্টা। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ মনে করেন, আকবরের প্রতিভার এক শতাংশ ও ফিরোজের মধ্যে ছিল না। তিনি লিখেছেনঃ "Firuz had not even a hundredth part of the genius of that great-hearted and broad-minded monarch (Akbar). " ফিরোজের কার্যাবলি বিশ্লেষণ করলে এই মন্তব্যের সত্যতা বোঝা যায়। শাসক, সাম্রাজ্যের সংগঠক, সমরনায়ক ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতা ছিল স্পষ্ট। সংস্কারক ও মানবতাবাদী হিসেবে তিনি যে কাজগুলি করেছিলেন; তা আপাতদৃষ্টিতে কল্যাণধর্মী মনে হলেও বাস্তবে সেগুলিই দিল্লি-সুলতানির ভিতকে দুর্বল করে তুলেছিল। তাই ড. আর. পি. ত্রিপাঠী লিখেছেন : “....the very qualities that had contributed to the popularity of Firuz were also largely responsible for the weakness of the Sultanate of Delhi."

ফিরোজ শাহ যখন সিংহাসনে বসেন তখন দিল্লি-সুলতানির ভগ্নদশা চলছে। দক্ষিণ ভারতসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল চলে গেছে সুলতানির নিয়ন্ত্রণের বাইরে। অভিজাতদের অসন্তোষ ও উচ্চাকাঙ্ক্ষাজনিত বিদ্রোহ, উলেমাদের সংঘবদ্ধ বিরোধিতা প্রভৃতি কারণে দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা তখন সংকটাপন্ন। সমগ্র পরিস্থিতি সম্পর্কে ফিরোজ অবহিত ছিলেন। কিন্তু কঠোর নীতি দ্বারা পরিস্থিতিকে নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে তিনি নমনীয় নীতি গ্রহণ করে আপসের পথ ধরেন। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ লিখেছেন : “অবাধ্য ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিজাতদের দমন করতে বা সাম্রাজ্যের সীমা সম্প্রসারিত করতে কোনো উদ্যোগ ফিরোজ নেননি” ("Firuz did nothing to win back the allegiance of disloyal governors and to restore the way of Delhi to its former extent. ")। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার প্রধানতম শর্ত যে, 'কঠোরতা ও সুলতানের প্রতি ভীতি' তাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার কোনো উদ্যোগই তিনি নেননি। অভিজাতদের সন্তুষ্ট করার জন্য ফিরোজ ভূতপূর্ব সুলতানের আমলে অভিজাতদের প্রদত্ত সমস্ত সরকারি ঋণ মকুব করে দেন। নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা-ই-জাহান মকবুল বহু অভিজাতকে রাজকোষ থেকে সোনা, রূপা উপঢৌকন প্রদান করেন। ঋণের দলিলপত্র নষ্ট করে অভিজাতদের নিশ্চিন্ত করেন। এমনকি রাষ্ট্রদ্রোহিতার কারণে মহম্মদ তুঘলক যে সকল ব্যক্তি বা পরিবারকে শাস্তি দিয়েছিলেন, ফিরোজ তাদের ক্ষতিপুরণ দিয়ে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করেন। অভিজাতদের কার্যকলাপ লক্ষ্য করার জন্য যে গুপ্তচরবাহিনী ছিল, তা-ও তিনি ভেঙে দেন। রাজনৈতিক অপরাধীদের দৈহিক শাস্তিপ্রদানের রীতি রদ করে দেন। তাঁর এই সকল কাজ অভিজাতদের হয়তো সন্তুষ্ট করে; কিন্তু সুলতানের কর্তৃত্বের প্রতি তাদের আস্থা ও ভীতি দূর হয়ে যায়। বলবন বা আলাউদ্দিন যে শক্তি বা Force দ্বারা সুলতানির ভিত্তি সুদৃঢ় করেছিলেন, সেই 'শক্তি'-কে ফিরোজ দুর্বল করে দেন।

আলাউদ্দিন, মহম্মদ-বিন্-তুঘলক প্রমুখ জায়গির-প্রথার বিরোধী ছিলেন। কারণ এই ব্যবস্থা সামস্ততান্ত্রিক প্রবণতার জন্ম দেয় এবং কেন্দ্রীভূত শাসনব্যবস্থার ভিতকে শিথিল করে তোলে। কিন্তু ফিরোজ শাহ ব্যাপক হারে জায়গির প্রদান করেন। সামরিক, বেসামরিক উভয় শ্রেণির কর্মী নগদ বেতনের পরিবর্তে জায়গির হিসেবে জমি ভোগ করতেন। এরা চড়া-হারে রাজস্বকে অগ্রাহ্য করে নিজেদের আর্থিক শক্তি ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। স্বভাবতই কেন্দ্রীয় সরকারকে অগ্রাহ্য করার একটা প্রবণতা এদের মনে জন্ম নেয়। পরন্তু, এরা অনেক ক্ষেত্রে জায়গিরের রাজস্ব নিজেরা আদায় না করে ‘ইজারা' দিয়ে দেন। এই সকল ইজারাদারও প্রজাসাধারণের ওপর জুলুম চালিয়ে নিজেদের শক্তিশালী করে তোলেন। ড. আর. পি. ত্রিপাঠী দেখিয়েছেন যে, ফিরোজ ভূমিরাজস্ব আদায়ের জন্য খালিসা জমিগুলিকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইজারা দিয়ে দেন। বিভিন্ন সরকারি কর্মচারী, ইক্তাদার, হিন্দু, খুৎ, মুকদ্দম এই ইজারা লাভ করেন। এরা রাজস্বের একটা অংশ এই কাজের বেতন হিসাবে ভোগ করতেন। কিন্তু এই শ্রেণি ক্রমে দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে ওঠে। এরা নির্দিষ্ট পরিমাণের বেশি রাজস্ব আদায় করলেও রাজকোষে জমা দিতেন না। অনেক ক্ষেত্রে এঁরা চুক্তির টাকা দিতে অস্বীকৃত হতেন। এঁদের অবাধ্যতা ও দুর্নীতি দূর করার কোনো চেষ্টা ফিরোজ করেননি। 'আইন-ই-মহরু' গ্রন্থে এজন্য ফিরোজের বিরূপ সমালোচনা করা হয়েছে। আফিফ লিখেছেন যে, সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তিদের প্রদত্ত জায়গির জমির ওপর দয়ালু সুলতান বংশানুক্রমিক ভোগদখলের অধিকার স্বীকার করে নেন। এমনকি জায়গিরদারের মৃত্যুর পর ভারপ্রাপ্ত জায়গির জীবিত পুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দেবার রীতিও সরকার মেনে নেয়। সরকারি ‘খালিসা' জমি ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত হয়। ফলে রাজকোষ দুর্বল হয় এবং কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা প্রকট হয়ে ও ওঠে। অভিজাতরা সন্তুষ্ট হয়; কিন্তু ক্ষীণ হয়ে আসে দিল্লি-সুলতানির স্থায়িত্ব।

এই ধরনের আর একটি বড়ো ভ্রান্তি ছিল ফিরোজের উলেমা-প্রীতি। সিংহাসনে অধিবেশনের প্রাক্কালে তিনি মুসলিম বুদ্ধিজীবী, উলেমা প্রমুখ মুসলমান ধর্মগুরুদের জন্য ভূমিদানের আদেশ দেন। তিনি খলিফার প্রতি আনুগত্য জানান এবং নিজেকে খলিফার ইসলামিক সাম্রাজ্যের ‘রক্ষক' বা 'অছি' বলে অভিহিত করেন। উলেমাদের সন্তোষবিধানের জন্য ‘শরিয়তি' আইন অনুসারে শাসন পরিচালনার সিদ্ধান্ত নেন। হিন্দুদের ওপর জিজিয়া কর স্থাপন করেন এবং অবিশ্বাসীদের ও পৌত্তলিকদের ইসলামধর্মে দীক্ষিতকরণকে সুলতানের পবিত্র কর্তব্য বলে ঘোষণা করেন। আকবরের দূরদর্শিতা ও চিন্তার স্বচ্ছতা থেকে ফিরোজের তফাত যে কত বেশি, এই একটি কাজই তা প্রমাণ করে দেয়। এমনকি আলাউদ্দিন খলজি ও মহম্মদ-বিন-তুঘলক ধর্মনীতির সাথে রাষ্ট্রনীতিকে জড়িত করার বিপদ সম্পর্কে যে আভাস দিয়ে গিয়েছিলেন, ফিরোজ তা-ও অনুধাবন করতে পারেননি। আকবর ও আলাউদ্দিনের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রনীতির উৎসমূলে প্রভেদ ছিল। আকবরের ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল আদর্শমূলক, আলাউদ্দিনের ক্ষেত্রে তা ছিল প্রয়োজনমূলক। কিন্তু উভয়েই বুঝেছিলেন যে, রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত রাখতে না পারলে রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ক্ষুণ্ণ হবে। অথচ ফিরোজ এই সত্য উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন, যদিও তাঁর পূর্ববর্তী শাসক উলেমাদের প্রভাবমুক্ত শাসন-প্রবর্তনের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। এর সাথে যুক্ত হয়েছিল ফিরোজের অসহিষ্ণু ধর্মীয় নীতি। হিন্দু মন্দির অপবিত্রকরণ ও ধ্বংসসাধন এবং অ-সুন্নি সম্প্রদায়ের প্রতি রূঢ় আচরণ করে তিনি দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি থেকে বঞ্চিত হন। জনসমর্থনের পরোয়া তিনি করেননি। স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থায় সেটা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু সেজন্য যে শক্তি (Force) ও মনোবল প্রয়োজন, ফিরোজের তা-ও ছিল না। ফলে কেন্দ্রীয় শাসনের ভিত্তিমূল দুর্বল হয়ে সুলতানি সাম্রাজ্যের স্থায়িত্ব নষ্ট করে দেয়। 

ড. মজুমদার লিখেছেন : “The active interest and influence of the Ulama and Mushaikhs in affairs of state which Firuz permitted, partly as policy and as an article of faith, was a retrograde step. ” ভারতের সহনশীল ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুধাবন করার মতো চিন্তার গভীরতা ফিরোজ শাহের ছিল না। এদিক থেকে আকবরের স্থান ছিল অনেক ঊর্ধ্বে। এক সর্বজনীন ধর্মীয় বন্ধনে তিনি সমগ্র ভারতকে বাঁধতে চেয়েছিলেন। কোনো ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ নয়, সর্বধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল তাঁর নীতির মূল উৎস। ফিরোজ ছিলেন প্রায় বিপরীত চরিত্রের শাসক। ধর্মীয় সংকীর্ণতাকে আশ্রয় করে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ অ-মুসলমান প্রজাসাধারণের মনন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। ভারতবর্ষের মতো বহুত্ববাদী সমাজে ফিরোজের নীতি ছিল বহুলাংশে আত্মহননকারী। তাই অধ্যাপক শৰ্মা (S. R. Sharma): "Firuz was neither an Ashoka nor an Akbar, both of whom have been noted of their religious toleration. Firuz was a fanatic like Aurangzeb…"

সমরনায়ক ও সেনাবাহিনীর সংগঠক হিসেবেও ফিরোজ শাহ ব্যর্থতার পরিচয় দেন। তাঁর আলস্য ও যুদ্ধবিমুখ মন তাঁকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে থাকতে প্ররোচিত করেছিল। মহম্মদ তুঘলকের মৃত্যুর সময় সুলতানি সাম্রাজ্যের যে ভাঙন শুরু হয়েছিল, তা রোধ করার কোনো চেষ্টাই তিনি করেননি। মধ্যযুগীয় স্বৈরাচারী শাসকের ক্ষমতার মূল উৎস যে রণদক্ষতা, তার একান্ত অভাব ছিল ফিরোজের চরিত্রে। দক্ষিণ ভারতকে পুনরায় সুলতানির অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ আসা সত্ত্বেও তিনি নিঃস্পৃহ থাকেন। বিদ্রোহী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুটি অভিযান করেও তিনি সেখানে সুলতানির কর্তৃত্ব স্থাপনে অসমর্থ হন। মুসলমান শিশু ও রমণীর রক্তপাত না করার অজুহাত দেখিয়ে তিনি বাংলা থেকে ফিরে আসেন। সিন্ধুর বিরুদ্ধে প্রথম অভিযানে তিনি চরমভাবে হেনস্থা হন। এমনকি পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির অভাবে কচ্ছের দুর্গম অঞ্চলে বহু সেনা ও অশ্বের মৃত্যু ঘটে। স্বভাবতই সুলতানের সামরিক নেতৃত্বের প্রতি সেনাদলের অনাস্থা জন্মে এবং তাদের মনোবল ভীষণভাবে ভেঙে যায়। তাঁর অপর দুটি মূল অভিযান ছিল ধর্মীয় সংকীর্ণতায় আচ্ছন্ন। জগন্নাথদেবের মন্দির ধ্বংস করার ধর্মীয় মোহ থেকে তিনি জাজনগর আক্রমণ করেণ। আর কাটিহার আক্রমণ করে মাত্র তিনজন সৈয়দের হত্যাকাণ্ডের বদলা হিসেবে তিনি কয়েক হাজার হিন্দুকে হত্যা করেন এবং অনেককে দাসে পরিণত করেন। তাঁর এই সকল কাজ আর যাই হোক্ সুলতানের সামরিক দক্ষতার পরিচয় দেয় না।

সেনাবাহিনীর সংগঠনের ক্ষেত্রেও তিনি ধারাবাহিক দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছিলেন। সামরিক সংগঠনে তিনি এমন কিছু নতুন উপাদান সন্নিবিষ্ট করেন, যা বাহিনীর কর্মদক্ষতা ও শৃঙ্খলা দ্রুত নষ্ট করে দেয়। সৈন্যদের বেতন নগদ অর্থে দেবার পরিবর্তে ফিরোজ তাদের 'ইকতা' বা জমি বন্দোবস্ত দেন। ফলে সেনাবাহিনীতে সামস্ততান্ত্রিক প্রবণতার প্রকাশ ঘটে। সুলতানকে বাহিনীর জন্য স্থায়ী আমির মালিকদের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। পরস্তু, সামরিক কর্মচারীদের ক্ষেত্রে বংশগত অধিকারের নীতি প্রয়োগ করে তার মেরুদণ্ড ভেঙে দেন। ইতিপূর্বে এক নির্দেশনামা জারি করে তিনি অভিজাতদের মৃত্যুর পর তার 'ইতা'র ওপর ওই অভিজাতের পুত্রের অধিকার স্বীকার করেছিলেন। পুত্রের অবর্তমানে তাঁর জামাতা এবং জামাতা না-থাকলে তাঁর ক্রীতদাস ওই সম্পত্তি পাবে বলে স্থির হয়। এই ব্যবস্থার ফলে ফিরোজের প্রশাসনে যোগ্য ব্যক্তির একান্ত অভাব প্রকট হয়ে উঠেছিল। এখন এই বিষময় বংশানুক্রমিক অধিকারের নীতি ফিরোজ সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেন। অর্থাৎ একজন সৈন্যের মৃত্যু হলে তাঁর পুত্র অথবা জামাতা অথবা ক্রীতদাস ওই পদে যোগদানের অধিকার পায়।। এজন্য ব্যক্তিগত যোগ্যতা বা দক্ষতা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ ছিল না। এর অনিবার্য ফল হিসেবে অদক্ষ ও অযোগ্য ব্যক্তিতে সেনাবাহিনী ভরে ওঠে এবং তার কর্মদক্ষতা ক্রমে শূন্যের কোঠায় পৌঁছে যায়। সমকালীন লেখকের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, সেনাবাহিনীর ও অশ্বের নিয়মমাফিক যোগ্যতা পরীক্ষার সময় তারা পরিদর্শকদের উৎকোচ দিয়ে অকেজো ঘোড়া চালিয়ে নিত। বদান্যতা দেখাতে গিয়ে ফিরোজ নিজেও নাকি একবার এক সৈনিককে পরিদর্শককে উৎকোচ দেবার জন্য অর্থসাহায্য করেছিলেন। দয়ালু ফিরোজ শেষ পর্যন্ত সৈন্য ও অশ্বের দক্ষতা পরিদর্শনের ব্যবস্থাটাকেই তুলে দেন। ফলে সুলতানি-বাহিনীর কর্মদক্ষতা নিদারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 'কেম্ব্রিজ হিস্ট্রি অব ইন্ডিয়ার’ তৃতীয় খণ্ডে লেখা আছে, "Firuz Shah's connivance of corruption and his culpable leniency destroyed the effects of his own reforms."

ক্রীতদাস সংগ্রহে ফিরোজ শাহের বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি প্রাদেশিক শাসকদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, কোনো স্থান আক্রমণ করলে সেখানকার সুদর্শন ও সদ্বংশজাত যুবকদের বাছাই করে যেন ক্রীতদাস হিসাবে সুলতানের কাছে পাঠানো হয়। এইভাবে ফিরোজ প্রায় এক লক্ষ আশি হাজার ক্রীতদাস সংগ্রহ করেন। এই বিশাল সংখ্যক ক্রীতদাস সংগ্রহের পেছনে তাঁর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। এদের অনেককে প্রশিক্ষণ দিয়ে কারিগর হিসেবে বিভিন্ন কারখানায় নিযুক্ত করা হয়। প্রায় ১২০০ ক্রীতদাস দক্ষ কারিগর হিসেবে উৎপাদনের কাজে দক্ষতা দেখায়। অন্যদের নিয়ে তিনি এক বিশাল রক্ষীবাহিনী গড়ে তোলেন। এই ক্রীতদাস-বাহিনী সরাসরি সুলতানের নিয়ন্ত্রণে থাকে। সাময়িকভাবে এরা সুলতানের হাতকে শক্তিশালী করেছিল। কিন্তু এই ব্যবস্থার পরিণতি ভালো হয়নি। ফিরোজের মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই এই সংগঠিত ক্রীতদাস-বাহিনী দিল্লির ক্ষমতাদখলের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। ফিরোজের ক্রীতদাসরা (এরা ‘ফিরোজী ক্রীতদাস' নামে অভিহিত হত) নিজেদের মনোনীত ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকার চেষ্টা করে।

সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের মানবিক গুণাবলির অভাব হয়তো ছিল না; কিন্তু শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন দুর্বল ও অলস। কোনো মৌলিক বা সৃজনশীল কর্মপ্রেরণা তাঁর ছিল না। রাষ্ট্রকে স্থিতিশীল ও শক্তিশালী করার কোনো উদ্যোগ তিনি নেননি। তাঁর সর্বোচ্চ লক্ষ্য ছিল স্থিতাবস্থা বজায় রাখা। এজন্য তিনি প্রথম থেকেই ছিলেন আপসপন্থী। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁর এই আপসনীতি সুলতানির দুর্বলতা ও অক্ষমতা হিসেবে প্রকট হয়েছে। আফিফের বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, বহুক্ষেত্রে অভিজাত ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের দুর্নীতি সম্পর্কে অবহিত থেকেও ফিরোজ তার প্রতিকার করেননি। যেমন–

(১) টাকশালের অধ্যক্ষ তাতার খাঁ মুদ্রায় অন্যায়ভাবে রূপার মাত্রা কমিয়ে দিতেন। সুলতান সব জেনেও তাকে অপসারিত করেননি। 

(২) সেনাপ্রধান ইমাদ-উল-মুল্ক (দেওয়ান ই-আর্জ) দুর্নীতি দ্বারা বহু অর্থ সঞ্চয় করেন এবং মাটির মধ্যে কূপ খুঁড়ে তা লুকিয়ে রাখেন। ফিরোজ এই সংবাদ পাওয়া সত্ত্বেও নিশ্চুপ থাকেন। 

(৩) সরকারি কারখানাগুলিতে দুর্নীতির ও অর্থ অপচয়ের সংবাদ জেনেও তিনি প্রতিবিধানের ব্যাপারে নিশ্চেষ্ট থাকেন। এই নগ্নতোষণ নীতি প্রশাসনের সর্বস্তরে ভাঙনের বীজ রোপণ করে।

যে কল্যাণমূলক কাজ ইতিহাসে ফিরোজ শাহকে মানবতাবাদের প্রতীক রূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে, তাও ত্রুটিমুক্ত ছিল না। ফিরোজ দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যকে ‘মুসলিম রাষ্ট্র' বলে বিবেচনা করতেন। তাই তাঁর অধিকাংশ কল্যাণমুখী কর্মসূচি, যেমন—শিক্ষা, দারিদ্র্যের সাহায্য, অনাথদের সাহায্য, কুমারী কন্যার বিবাহ, পণ, ধর্মীয় দান প্রভৃতি, প্রধানত মুসলমান নারী-পুরুষের সাহায্যার্থে গৃহীত হয়েছিল। আফিফের লেখাতেও এই মন্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায়। অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ রাজপদে কেবল মুসলমানরাই নিযুক্ত হতেন, যোগ্যতা থাকলেও হিন্দুরা, কেবল ধর্মীয় কারণে, গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কর্ম সম্পাদনের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। সিরাজুল ইসলাম লিখেছেন : “Political power remained exclusively in Muslim hands and no post of influence is known to have been held by any Hindu." উলেমা বা মুসলমান ধর্মগুরুদের প্রতি ফিরোজের দুর্বলতা ও নির্ভরতার কথা আমরা আগেই উল্লেখ করেছি। এই দিক থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলক কেবল মুঘল সম্রাট আকবরের থেকে অনেক পেছনে ছিলেন তাই নয় ; আকবরের বিপরীতে ছিলেন বলা যায়। ড. মজুমদার লিখেছেনঃ “In all these respects Firuz offers a striking contrast to Akbar and to a certain extent to Sher Shah." 

ফিরোজের চরিত্র ও কার্যাবলির ভিত্তিতে ড. মজুমদার মনে করেন যে, ফিরোজের রাজত্বকালকে সম্রাট আকবরের শাসনপূর্ব কালের সর্বোত্তম অধ্যায় বলাও যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ উভয়ের মাঝে আগত আফগান শাসক শের শাহ শাসক, সংগঠক ও সমরনায়ক হিসেবে ফিরোজের থেকে কোনো অংশে কম ছিলেন না। তাই ড. মজুমদার ফিরোজ শাহ তুঘলককে সুলতানি সাম্রাজ্যের শেষ উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধি (last of the notable Sultans of Delhi) বলার পক্ষপাতী। একথা সত্য যে, ফিরোজ শাহ তুঘলকের বহু কাজ সাধারণ মানুষের হৃদয়কে স্পর্শ করেছিল। কিন্তু পরিণতিতে সেই সকল কাজই সুলতানি সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। ড. ত্রিপাঠী (R. P. Tripathy) যথার্থই বলেছেন : “ইতিহাসের পরিহাস এরূপ দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার মধ্য দিয়েই প্রকাশিত হয়, যেসব গুণাবলি ফিরোজের জনপ্রিয়তা অর্জনে সাহায্য করেছে, সেগুলি অধিক পরিমাণে দিল্লি-সুলতানির দুর্বলতার কারণ হয়ে উঠেছে।”

অনুরূপভাবে ড. রমেশচন্দ্র মজুমদারও সুলতানির অবক্ষয় ও পতনের জন্য ফিরোজ শাহকে দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, ফিরোজ শাহের সাফল্য ছিল আপাত এবং সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক উপাদানে ভরা। একথা ঠিক, তাঁর রাজত্বকালে শান্তি ও সমৃদ্ধির পক্ষে বিপজ্জনক কোনো শক্তির সক্রিয়তা চোখে পড়ে না। কিন্তু তাঁর রাষ্ট্রনীতি, ধর্মনীতি ইত্যাদি বহুজাতিক একটি রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব ও প্রগতির অনুকূল ছিল না। ফিরোজের আপসমুখীনতা সাম্রাজ্যের মূল ভিত্তিকে দুর্বল করেছিল। তাঁর প্রশাসনিক ব্যবস্থাদি দিল্লি-সুলতানির অবক্ষয় ও পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল। তিনি লিখেছেন : "On the whole inspite of peace and prosperity and contentment that prevailed during the reign of Firuz Shah.... his policy and administrative measures contributed to a large extent to the downfall of the Delhi Sultanate, and accelerated the process of decline…"

ফিরোজ শাহ তুঘলকের উত্তরাধিকারীগণ :

ফিরোজ শাহের শেষ জীবন খুব সুখের ছিল না। জ্যেষ্ঠ পুত্র ফত্ খাঁ'র অকালমৃত্যু তাঁর মন ভেঙে দেয়। অত্যধিক বয়সের ভারে তাঁর বিচারবুদ্ধিও দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সময় অপর পুত্র নাসিরউদ্দিন মহম্মদ খানের সহায়তায় তিনি প্রশাসন চালাতে চেষ্টা করেন। কিন্তু নাসিরউদ্দিনের আচার-ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে বহু প্রভাবশালী অভিজাত তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। নাসিরউদ্দিন রাজধানী ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। বৃদ্ধ ও অসমর্থ ফিরোজ শাহ মৃত ফত্‌ খাঁ'র পুত্র তুঘলক শাহকে নিজ উত্তরাধিকার মনোনীত করেন। ফিরোজের মৃত্যুর (২০ সেপ্টেম্বর, ১৩৮৮ খ্রিঃ) পর তুঘলক শাহ “দ্বিতীয় গিয়াসউদ্দিন তুঘলক উপাধি নিয়ে সিংহাসনে বসেন (১৩৮৮-৮৯ খ্রিঃ)। শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ এবং মানুষ হিসেবে অবিবেচক ও বিলাসপ্রিয়। অল্পদিনের মধ্যেই প্রভাবশালী আমির ও মালিকদের তিনি শত্রুতে পরিণত করেন। ফলে তিনি এক প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের বলি হন। অতঃপর সিংহাসনে বসেন ফিরোজের তৃতীয় পুত্র জাফর খাঁর পুত্র আবু বকর (১৩৮৯-৯০ খ্রিঃ)। এই সময় দিল্লি-সুলতানি দরবারী ষড়যন্ত্রের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিভিন্ন আমির ও মালিক নিজ নিজ স্বার্থচিন্তা অনুসারে সিংহাসনের বিভিন্ন দাবিদারকে সমর্থন করতে থাকেন। সামানা'র সদাহ আমিররা ফিরোজের পুত্র নাসিরউদ্দিন মহম্মদকে সিংহাসন দখলের জন্য আহ্বান জানালে নাসিরউদ্দিন সসৈন্যে দিল্লির দিকে অগ্রসর হন। কিন্তু তাঁর পর পর দুটি প্রচেষ্টা আবু বকর ব্যর্থ করে দেন। ব্যর্থতা সত্ত্বেও লাহোর, মুলতান, হিসার, হাঙ্গী প্রভৃতি অঞ্চলে মহম্মদের সমর্থন বাড়তে থাকে। বহু অভিজাত তাঁকে গোপনে সমর্থন জানান। শেষ পর্যন্ত নাসিরউদ্দিন দিল্লির সিংহাসন দখল করেন। আবু বকরকে মিরাট দুর্গে বন্দি করা হয়। কিন্তু গৃহবিবাদ ও অভিজাতদের ষড়যন্ত্রের প্রবল চাপে নাসিরউদ্দিনের স্বাস্থ্য ভেঙে পড়ে। পাঁচ বছর রাজত্ব করেই তিনি মারা যান (১৩৯৪ খ্রিঃ)। এরপর সিংহাসনে বসেন নাসিরের পুত্র হুমায়ুন শাহ। কিন্তু তিনিও মাস তিনেকের মধ্যে মারা যান।

অতঃপর সিংহাসনে বসেন মহম্মদের কনিষ্ঠ পুত্র নাসিরউদ্দিন মামুদ তুঘলক (১৩৯৪-১৪১৩ খ্রিঃ)। নাসিরউদ্দিন মামুদও দৃঢ়চেতা ব্যক্তি ছিলেন না। প্রশাসকের দক্ষতা ও দূরদৃষ্টিরও একান্ত অভাব ছিল তাঁর চরিত্রে। ফলে দিল্লি-সুলতানি আমির, মালিকদের স্বার্থসিদ্ধির লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়। ফিরোজ শাহ তুঘলকের এক পুত্র নসরৎ শাহ সিংহাসন দাবি করলে কিছু অভিজাত তাঁকেই সমর্থন করে। নাসিরউদ্দিন ও নসরৎ শাহ যথাক্রমে দিল্লি ও ফিরোজাবাদ থেকে সুলতানি চালাতে থাকেন। অভিজাতরা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনকে সমর্থন করতে থাকেন। দোয়াব, ফিরুজাবাদ, সম্বল, পানিপথ, রোটক অঞ্চলের আমিরগণ নসরৎ শাহকে সমর্থন করেন, অন্যদিকে দিল্লির আমিররা দাঁড়ান মামুদ শাহ'র পেছনে। প্রকৃত অর্থে এঁদের কারও প্রতিই অভিজাতদের আনুগত্য ছিল না। তাঁরা কেবল স্বার্থসিদ্ধির চিন্তায় এক এক পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন। এই গৃহযুদ্ধের অনিবার্য ফলস্বরূপ কেন্দ্রীয় শাসনশৃঙ্খলা সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। ফেরিস্তা তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থা বর্ণনা করে লিখেছেন : “প্রশাসন সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়ে; গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে সারা দেশে ; এবং এক অশ্রুতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয় যে একই রাজধানীতে অবস্থান করে দুজন রাজা পরস্পরের মধ্যে সংগ্রামে লিপ্ত থাকেন।” এই পরিস্থিতিতে প্রাদেশিক শাসক ও হিন্দু সামন্তরা দিল্লির আধিপত্য অগ্রাহ্য করতে শুরু করে। খাজা জাহান নিজেকে পূর্বাঞ্চলের শাসক ('মালিক-উস্-সার্ক') বলে ঘোষণা করেন। জৌনপুরে তিনি স্বাধীন সুলতানি প্রতিষ্ঠা করেন। একে একে গুজরাট, মালব, খান্দেশ, কাল্পী, বিয়ানা, গোয়ালিয়র অঞ্চলের শাসকরা স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দোয়াব, মেওয়াট অঞ্চল চরম বিশৃঙ্খলার মধ্যে পতিত হয়। এইরূপ সংকটজনক রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে মোঙ্গল বীর তৈমুর লঙ ভারত আক্রমণ করেন। দুর্বল সুলতানি সরকার তৈমুরের বিরুদ্ধে সামান্যতম প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারেনি। নির্বিচারে হত্যা ও লুণ্ঠন চালিয়ে তৈমুর স্বদেশে ফিরে যান। অতঃপর মামুদ শাহ পুনরায় দিল্লিতে ফিরে আসেন। তবে এই সময় তিনি স্বাধীনতা হারিয়ে কিছুদিন মন্নু ইকবাল ও কিছুদিন দৌলত খাঁ'র নিয়ন্তাধীনে থেকে কোনোক্রমে সুলতানের অভিনয় করে যান। ১৪১৩ খ্রিস্টাব্দে নাসিরউদ্দিন মামুদ শাহ মারা যান। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে ভারতে দুশো বছরের বেশি স্থায়ী তুর্কি শাসনের অবসান ঘটে।

আশা করি আমার ভাই বোনের এই পোস্টটি অনেক ভালো লেগেছে। এর সাথে শাসক হিসেবে ফিরোজ শাহ-র মূল্যায়ন : সুলতানির পতনে দায়িত্ব বিষয়টিও তোমরা বুঝতে পেরেছ। যদি এই পোস্টটি থেকে কিছু উপকার পাও, তাহলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে কখনো ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন