কৃষ্ণদেব রায় ও তাঁর কৃতিত্ব: আসসালামু আলাইকুম ভাই ও বোনেরা আপনারা কেমন আছেন? আশা করি ভালো আছেন, আমিও আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি, আপনাদের স্বাগতম জানাচ্ছি লাখ পড়া মাইমুনা তে। আমার নাম মাইমুনা, আজকে আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আপনাদের বিভিন্ন জায়গায় লাগতে পারে।
আমি জানি আপনারা “কৃষ্ণদেব রায় ও তাঁর কৃতিত্ব” বিষয়ে ধারণা নিতে অনলাইনে খোজাখুঝি করছেন।আর আপনি এখন একদম সঠিক পোস্ট এ আছেন। এখানে আপনি এই বিষয়টি সম্পর্কে সব ভালো ভাবে জানতে পারবেন।
কৃষ্ণদেব রায় ও তাঁর কৃতিত্ব
বীর নরসিংহের পর তাঁর সৎ-ভ্রাতা কৃষ্ণদেব রায় বিজয়নগরের সিংহাসনে বসেন। তিনি কেবল এই বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন না; অনেকেই তাঁকে বিজয়নগরের সমস্ত রাজার মধ্যে শ্রেষ্ঠতম শাসক বলে মনে করেন। এই মূল্যায়ন অযৌক্তিকও নয়। ব্যক্তিগত গুণাবলীর বিচারে তিনি ছিলেন অসাধারণ। সামরিক ও অসামরিক উভয় কাজে তাঁর দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। তাঁর রাজত্বকালে (১৫০৯-৩০ খ্রিঃ) বিজয়নগরের রাজ্য গৌরবের শীর্ষে আরোহণ করেছিল। বহিরাগত প্রায় সকল পর্যটকই রাজা কৃষ্ণদেবের চরিত্রের ও কৃতিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। যোদ্ধা হিসেবে তিনি ছিলেন সাহসী ও দক্ষ, কূটনীতিবিদ হিসেবে বিচক্ষণ, শাসক হিসেবে প্রজাদরদী, মানুষ হিসেবে ন্যায়পরায়ণ, দয়ালু এবং সংস্কৃতিমনস্ক।
কৃষ্ণদেব রায়ের সিংহাসনারোহণ কালে দেশ অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে সমস্যাকীর্ণ ছিল। বীর নরসিংহ প্রাদেশিক শাসকদের দমন করলেও কেন্দ্রীয় সরকারের কর্তৃত্ব তখনো সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল না।
দেশের নানা অংশে ক্ষমতাবান পলিগারগণ কেন্দ্রের আনুগত্য অস্বীকার করতে দ্বিধান্বিত ছিল না। বিজয়নগরের পূর্বাঞ্চল উড়িষ্যার রাজা গজপতির দখলে ছিল। বাহমনী রাজ্য ভেঙে গেলেও বিজয়নগরের বিরুদ্ধে মুসলমান সুলতানদের প্রতিরোধ তখনো ছিল অব্যাহত। উত্তর সীমান্তে নবগঠিত বিজাপুর সুলতানি বিজয়গনরের পক্ষে যথেষ্ট শঙ্কার কারণ হয়ে উঠেছিল। কৃষ্ণদেব রায় যথেষ্ট সাহস ও বিচক্ষণতার সাথে এই বহুমুখী সমস্যার মোকাবিলা করেন।
শাসনের শুরুতেই কৃষ্ণদেব বাহমনী রাজ্যের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। সুলতান মামুদ শাহ বিশাল বাহিনী ও অভিজাতবৃন্দের সাহায্যপুষ্ট হয়ে বিজয়নগর আক্রমণ করেন (১৫০৯ খ্রিঃ)। 'দোনি ও কোভেলা কোণ্ডার' যুদ্ধে বিজাপুরের শাসক ইউসুফ আদিল শাহ নিহত হন।
এর ফলে সদ্যগঠিত বিজাপুর রাজ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সেই সুযোগ নেন রাজা কৃষ্ণদেব। ১৫১২ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণদেব রায় কৃষ্ণা-তুঙ্গভদ্রার 'দোয়াব' আক্রমণ করে ‘রায়চুর দুর্গ' দখল করে নেন। অতঃপর তিনি 'গুলবর্গা দুর্গ'ও দখল করতে সক্ষম হন।
'বিদর' আক্রমণ করে 'বারিদ' দুর্গটিও তিনি হস্তগত করেন। এরপর কৃষ্ণদেব কূটনৈতিক চাল হিসেবে মামুদ শাহকে বাহমনী রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। এই কাজকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য তিনি যবন রাজ্যস্থাপন আচার্য উপাধি নেন। কৃষ্ণদেব রায় জানতেন যে, স্বাধীন ও স্বতন্ত্র বাহমনী রাজ্যের অস্তিত্ব বিজাপুর, গোলকুণ্ডা প্রভৃতি নবগঠিত রাজ্যগুলির কাছে সহনীয় হবে না। এই সুত্রে মুসলিম রাজ্যগুলির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব দেখা দেবে এবং তাদের দুর্বলতার কারণ সৃষ্টি করবে।
এরপর কৃষ্ণদেব রায় দক্ষিণ-মহীশূরের বিদ্রোহী শাসক পলিগার-এর বিরুদ্ধে অভিযান চালান। বীর নরসিংহের আমল থেকে উচ্চ-কাবেরী উপত্যকা অঞ্চলে জনৈক পলিগারের স্বাধীন শাসন চলছিল।
পলিগারের স্পর্ধা ও শক্তির মূলে ছিল 'শ্রীরঙ্গপত্তম্' ও 'শিবনসমুদ্রম্' নামক দুটি দুর্গের অস্তিত্ব। কাবেরীর দুটি শাখার মধ্যবর্তী বদ্বীপে অবস্থিত এই দুর্গ ছিল অজেয়। যাই হোক, কৃষ্ণদেব প্রথমে শ্রীরঙ্গপত্তম দখল করেন। বিপদ বুঝে উমাত্তুরের শাসক গঙ্গারাজা শিবনসমুদ্রমে সরে যান। কৃষ্ণদেব এটিও দখল করেন। পলায়মান গঙ্গারাজা কাবেরীর জলে ডুবে মারা যান। কৃষ্ণদেব রায় এই অঞ্চলে একটি নতুন প্রশাসনিক কেন্দ্র গড়ে তোলেন। প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয় 'শ্রীরঙ্গপত্তমে'।
উড়িষ্যার রাজা গজপতি প্রতাপরুদ্র বিজয়নগরের অন্তর্গত 'উদয়গিরি'ও 'কোণ্ডাভিডু'অঞ্চল দুটি আগেই দখল করেছিলেন। পূর্ববর্তী বিজয়নগর রাজারা তা পুনর্দখলের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন।
এখন কৃষ্ণদেব রায় হৃতরাজ্য পুনরুদ্ধারে উড়িষ্যার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অগ্রসর হন। বিজয়নগর-বাহিনী পরপর ‘উদয়গিরি' (১৫১৩ খ্রিঃ) ও ‘কোণ্ডাভিডু' (১৫১৪ খ্রিঃ) দখল করে। কৃষ্ণানদীর তীর পর্যন্ত উপকূল অঞ্চল কৃষ্ণদেব রায়ের হস্তগত হয়। কোণ্ডাভিডু'র পতনের সাথে সাথে উড়িষ্যার যুবরাজ ও ভাবীরাজা বীরভদ্র ও গজপতির এক রানী কৃষ্ণদেবের হাতে বন্দি হয়ে বিজয়নগরে আনীত হন। উড়িষ্যার বিরুদ্ধে অন্য দুটি যুদ্ধ দ্বারা কৃষ্ণদেব বেজওয়াদা এবং কোন্দাপল্লী দুর্গ দুটিও দখল করে নেন। এই অঞ্চল দখল করার ফলে উড়িষ্যার অধীনস্থ তেলেঙ্গানা ও ভেঙ্গী দখল করার জন্য কৃষ্ণদেব উৎসাহিত বোধ করেন।
চতুর্দশ ও পঞ্চদশ শতকে তেলেঙ্গানা ভেলমাদের অধীনে ছিল। জনৈক সিতাব খাঁ (সীতাপতি) গজপতির সাহায্য নিয়ে ওই অঞ্চল দখল করে শাসন করছিলেন। কৃষ্ণদেব রায় তেলেঙ্গানা আক্রমণ করলে গজপতি সীতার খাঁ'র সাহায্যে অগ্রসর হয়। কিন্তু কৃষ্ণদেবের অপ্রতিরোধ্য বাহিনী তেলেঙ্গানা দখল করে রাজামুন্ত্রী পর্যন্ত অগ্রসর হয়। রাজামুন্ত্রী ও ভেঙ্গী বিজয়নগরের হস্তগত হয়। অতঃপর সামান্য বিরতির পর কৃষ্ণদেব উড়িষ্যার রাজধানী কটক আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেন। শেষ পর্যন্ত রাজা গজপতি কৃষ্ণদেবের কাছে শান্তির প্রস্তাব পাঠাতে বাধ্য হন। মৈত্রীর প্রমাণস্বরূপ গজপতি নিজ কন্যাকে কৃষ্ণদেবের সাথে বিবাহ দেন এবং পরিবর্তে কৃষ্ণানদীর উত্তরাংশে শাসন করার অধিকার ফিরে পান। পর্যটক নুনিজ-এর মতে, গজপতির পুত্র বীরভদ্র বিজয়নগরে বন্দি অবস্থায় আত্মহত্যা করার ফলে গজপতির মন ভেঙে গিয়েছিল এবং তিনি ভগ্নমনোরথ হয়ে সন্ধির প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
উড়িষ্যার সাথে যুদ্ধে কৃষ্ণদেব রায়ের ব্যস্ততার সুযোগে গোলকুণ্ডার শাসক কুলি কুতুব শাহ বিজয়নগরের সীমান্তবর্তী দুর্গ পাঙ্গল, গুন্টুর ইত্যাদি দখল করে নেন। গজপতির উপর্যুপরি ব্যর্থতার সুযোগে সীতাব খাঁ'র কাছ থেকে কুতুব শাহ বেশকিছু দুর্গ দখল করে নেন। কৃষ্ণা-গোদাবরীর মধ্যবর্তী ভূভাগ দখল করার পর তিনি বিজয়নগরের অধীনস্থ কোণ্ডাভিডু দুর্গ দখল করেন। অবশ্য কৃষ্ণদেবের সাহায্যে কোণ্ডাভিডু'র দুর্গাধিপতি সালুভ তিম্মা গোলকুণ্ডার বাহিনীকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন।
বিজাপুর রাজের বিরুদ্ধে কৃষ্ণদেব রায়ের সাফল্য ছিল উল্লেখযোগ্য। একাধিকবার তিনি এই মুসলিম রাজ্যের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং প্রতিবারেই বিজয়ী হন। ইতিপূর্বে কৃষ্ণদেব যখন ‘রায়চুর দুর্গ’দখল করেন (১৫১২ খ্রিঃ) তখন বিজাপুরের ইসমাইল আদিল শাহ ছিলেন নাবালক। সাবালক হয়ে ক্ষমতা দখল করার সঙ্গে সঙ্গে ইসমাইল আদিল ‘রায়চুর' দুর্গ পুনর্দখলের উদ্যোগ নেন এবং কৃষ্ণদেব রায়ের উড়িষ্যা-যুদ্ধে ব্যস্ততার সুযোগে 'রায়চুর' দখল করতে সক্ষম হন।
১৫২০ খ্রিস্টাব্দে সালুভ তিম্মার নেতৃত্বে বিজয়নগর-বাহিনী রায়চুর পুনরুদ্ধারের জন্য যুদ্ধ শুরু করে। বিজাপুর-বাহিনী যুদ্ধে বিধ্বস্ত হয় এবং আদিল শাহ প্রাণভয়ে আত্মগোপন করেন। অবশ্য তার পরেও মুসলমান বাহিনী দুর্গের অবরোধ চালিয়ে যায়। কৃষ্ণদেব রায় শেষ পর্যন্ত পোর্তুগীজ গোলন্দাজদের সাহায্যে দুর্গ দখল করেন। কিছুদিনের মধ্যে ইসমাইল আদিল বিজয়নগরে দূত প্রেরণ করে রায়চুর প্রত্যাবর্তনের দাবি জানান। প্রত্যুত্তরে কৃষ্ণদেব জানান যে, বিজাপুর সুলতান রাজা কৃষ্ণদেবের পদচুম্বন করে কৃতজ্ঞতা জানালে তিনি রায়চুর ফিরিয়ে দেবেন। আদিল খাঁ প্রথমে এই শর্তে রাজি হন, যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি তা করেননি।
পরন্তু নানাভাবে কৃষ্ণদেবকে উত্ত্যক্ত করতে থাকেন। ক্রুদ্ধ কৃষ্ণদেব রায় এক বিশাল বাহিনীসহ বিজাপুর আক্রমণ করেন এবং বিজাপুর বাহিনীকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে 'গুলবর্গা' দখল করেন। নুনিজ লিখেছেনঃ কৃষ্ণদেব গুলবর্গা শহর ধ্বংস করেন এবং দুর্গটিকে ধূলিস্মাৎ করে দেন। অতঃপর তিনি বাহমনী সুলতান দ্বিতীয় মহম্মদ শাহের জ্যেষ্ঠ পুত্রকে ওই অঞ্চলের শাসক নিযুক্ত করে মহম্মদ শাহের অন্য দুই পুত্রসহ বিজয়নগরে ফিরে আসেন। বাহমনী রাজ্যের ভগ্নস্তূপের ওপর গড়ে ওঠা রাজ্যগুলির সামনে কাঁটার মতো বাহমনী রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার জন্যই সম্ভবত কৃষ্ণদেব এই ব্যবস্থা নেন। এটি তাঁর কূটনৈতিক জ্ঞানের পরিচায়ক।
পোর্তুগীজ বণিকদের সাথে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে কৃষ্ণদেব বিচক্ষণতার পরিচয় দেন। ইতিমধ্যে পোর্তুগীজরা বেশ শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল। আরব ও পারসিক নাবিকদের পরাস্ত করে এবং মিশরীয় নৌবাহিনী ধ্বংস করে পোর্তুগীজরা কার্যত অশ্বের বাণিজ্যে একচেটিয়া কর্তৃত্ব অর্জন করেছিল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর দক্ষতাবৃদ্ধির জন্য এই অশ্বের জোগান ছিল আবশ্যিক। তাই কৃষ্ণদেব পোর্তুগীজ বণিকদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি গ্রহণ করেন। এর ফলে তিনি উন্নতমানের অশ্বের জোগান পান।
কৃষ্ণদেবের বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহারের জন্য বহু পোর্তুগীজ পর্যটক ও দূত তাঁর রাজ্যে আগমন করেন ও অবস্থান করেন। অবশ্য পোর্তুগীজদের বাণিজ্যে হস্তক্ষেপ না করলেও, তাদের রাজনৈতিক উচ্চাশাকে বা কার্যকলাপকে কৃষ্ণদের কখনো সমর্থন করেননি। কোনো কোনো পণ্ডিত মনে করেন, পোর্তুগীজদের প্রতি কৃষ্ণদেবের আপসনীতি ভবিষ্যতে ভারতের পক্ষে ক্ষতিকারক হয়েছিল। নৌবাহিনীর উন্নয়ন ও পোর্তুগীজদের প্রতিপত্তিবৃদ্ধি নিরোধের ব্যাপারে নিস্পৃহ থেকে রাজা কৃষ্ণদেব অদূরদর্শিতার পরিচয় দেন।
গুলবর্গা থেকে প্রত্যাবর্তনের পর কৃষ্ণদেব অসুস্থ হয়ে পড়েন। এই সময় তিনি নাবালক পুত্র তিরুমালাদেব মহারাজাকে সিংহাসনে বসিয়ে নিজে তাঁর অভিভাবক রূপে শাসন পরিচালনা করতে শুরু করেন। কিন্তু আট মাস পরে এই পুত্র অকস্মাৎ অসুস্থ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। কৃষ্ণদেব জানতে পারেন যে, তাঁর বিশ্বস্ত মন্ত্রী সালুভ তিম্মার পুত্র তিম্মা দণ্ডনায়কের ষড়যন্ত্রের ফলেই তাঁর প্রিয় পুত্রের প্রাণনাশ হয়েছে। ক্ষুব্ধ রাজা দণ্ডনায়ককে বন্দি করেন। কিন্তু কিছুদিন পর তিম্মা নিজেকে মুক্ত করে কৃষ্ণদেবের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হন। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণদেব তিম্মাকে বন্দি ও হত্যা করে শান্তি ফিরিয়ে আনেন। ১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে রাজা কৃষ্ণদেব গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়লে জনৈক আত্মীয় অচ্যুত রায়কে তাঁর উত্তরাধিকারী মনোনীত করেন। ১৫৩০ খ্রিস্টাব্দে তাঁর সফল ও কর্মময় জীবনের অবসান ঘটে।
কেবল সুযোদ্ধা নয়, বিচক্ষণ শাসক ও সংস্কৃতিমনস্ক ব্যক্তি হিসেবেও রাজা কৃষ্ণদেব রায় সমসাময়িক লেখকদের প্রশংসা অর্জন করেছেন। পোর্তুগীজ পর্যটক ও বণিক পায়েজ, নুনিজ, বারবোসা প্রমুখ কৃষ্ণদেবের রাজসভায় বেশ কিছুদিন কাটিয়েছেন। এঁদের বিবরণী থেকে তাঁর ব্যক্তিগত গুণাবলী ও চারিত্রিক মাধুর্যের আভাস পাওয়া যায়।
পায়েজ লিখেছেন : “তিনি (কৃষ্ণদেব) ছিলেন একজন মহান শাসক ও ন্যায়বিচারক। তবে আকস্মিক তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতেন।" সিওয়েল (Sewell ) লিখেছেনঃ “He was real ruler. He commanded his enormous armies in person, was able, brave and statesmanlike, and was a man of much gentleness and generosity of character. "
প্রজাদরদী ও পরিশ্রমী শাসক হিসেবেও কৃষ্ণদেব সমসাময়িক লেখকদের প্রশংসা অর্জন করেছেন। প্রশাসনের খুঁটিনাটি বিষয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে খোঁজখবর রাখতেন।
বছরে অন্তত একবার তিনি সারা রাজ্য পরিভ্রমণ করে ব্যক্তিগতভাবে প্রজাদের অভাব-অভিযোগ শুনতেন এবং তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করতেন। ড. ভেঙ্কটরামনাইয়া (N. Venkatramanayya) লিখেছেন, কৃষ্ণদেবের এই ব্যবস্থার ফলে আঞ্চলিক শাসকদের প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ন্ত্রিত ছিল এবং এই গণসংযোগ রাজতন্ত্রকে দৃঢ়ভিত্তি দিয়েছিল। কৃষিব্যবস্থার উন্নয়নে তিনি বিশেষ যত্নবান ছিলেন। সেচব্যবস্থার উন্নতির জন্য কৃষ্ণদেব একাধিক সেচ-খাল ও কূপ খনন করেন।
প্রজাদের ওপর থেকে কয়েকটি জবরদস্তিমূলক কর, যেমন বিবাহ-কর তুলে দিয়ে তিনি সাধারণ মানুষের ভার লাঘব করেন। কৃষিজমি বৃদ্ধির জন্য তাঁর নির্দেশে বহু জঙ্গল কেটে সেখানে চাষযোগ্য জমি তৈরি করা হয়েছিল। ড. ঈশ্বরীপ্রসাদ মনে করেন, রাজা কৃষ্ণদেব প্রজাকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন। তিনি লিখেছেন: "Krishna Deva Raya was always anxious to promote the welfare of his subjects. His liberal endowments endered him all the more to his subjects."
কৃষ্ণদেব রায়ের রাজত্বকাল দক্ষিণ ভারতের সাহিত্যে এক নবযুগের সূচনা করেছিল। কৃষ্ণদেব স্বয়ং তেলেগু ও সংস্কৃত ভাষার প্রতিভাবান পণ্ডিত ছিলেন। কবি ও সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতাকে তিনি রাজার অন্যতম কর্তব্য বলেই বিবেচনা করতেন। একজন সাহিত্যসেবী হিসেবে তিনি সংস্কৃত, কানাড়ি সহ দক্ষিণ ভারতের সমস্ত ভাষার চর্চাকে উৎসাহিত করতেন। তবে তেলেও সাহিত্যের বিকাশের ক্ষেত্রে কৃষ্ণদেবের আমল তেলেগু ভাষার স্বর্ণযুগ রূপে বিবেচিত হতে পারে। ড. সতীশ চন্দ্র লিখেছেনঃ "তাঁর রাজত্বকালে তেলেগু সাহিত্যে এক নবযুগের সূচনা হয়। কারণ এই সময়েই সংস্কৃত সাহিত্যের অনুসরণ না করে তেলেগু ভাষায় স্বাধীন রচনার সূত্রপাত হয়।"
এন ভেঙ্কটরামনাইয়া লিখেছেন: প্রতি বছর বসন্ত-উৎসবের সময় তাঁর রাজসভায় দেশের প্রখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিকদের আমন্ত্রণ করে কৃষ্ণদেব তাঁদের বহু মূল্যবান উপহার দিয়ে সম্মানিত করতেন। দেশের আটজন প্রখ্যাত পণ্ডিত তাঁর রাজসভা আলোকিত করতেন। এঁরা ‘অষ্টদিগ্গজ' নামে সম্মানিত ছিলেন। কৃষ্ণদেব স্বয়ং একাধিক সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ফলে সেগুলির মধ্যে মাত্র দুটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেছে। এগুলি হল তেলেগু ভাষায় রচিত ভারতে রাষ্ট্রদর্শন-বিষয়ক গ্রন্থ আমুক্তমাল্যদা এবং সংস্কৃত ভাষায় রচিত নাটক জাম্ববতি কল্যাণম্। এ ছাড়া অম্লসনি পেড্ডান-এর মনুচরিতম্, নন্দী তিমায়া'র পারিজাত পহরনামু প্রভৃতি তেলেগু ভাষায় সাহিত্যচর্চার প্রধানতম ফসলরূপে স্বীকৃতি পেয়েছে। পেড্ডান অন্ধ্রকবিতা পিতামহ নামে সম্মানিত ছিলেন। কৃষ্ণদেবের উদ্যোগে তেলেগু ভাষা-সাহিত্যের অভূতপূর্ব বিকাশের প্রেক্ষিতে ড. ভেঙ্কটরামনাইয়া লিখেছেন : “The Augustian age of Telegu literature, which began with the accession of Saluva Narasimha, burst forth in full splendour in the reign of Krishnadeva Raya, and his court become the centre of light and learning in the country."
কৃষ্ণদেব একজন মহান নির্মাতাও ছিলেন। বিজয়নগরের অনতিদূরে মাতা নাগলম্ব'র স্মৃতির উদ্দেশ্যে তিনি একটি সুসজ্জিত নতুন শহর নির্মাণ করেন। এই শহর নাগালপুর নামে পরিচিত হয়। এ ছাড়া কৃষ্ণমন্দির, হাজার স্বামীমন্দির, বিঠলমন্দির প্রভৃতি তাঁর স্থাপত্যকীর্তি ও ধর্মভাবনার অন্যতম নিদর্শন।
ধর্মীয় উদারতা ও পরধর্মসহিষ্ণুতা ছিল কৃষ্ণদেব রায়ের চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি নিজে ছিলেন বৈষ্ণব। কিন্তু সমস্ত ধর্মের প্রতি ছিল তাঁর সমান শ্রদ্ধাবোধ। তাঁর সাম্রাজ্যে প্রজাদের ধর্মাচরণ সম্পর্কে কোনো বিধিনিষেধ ছিল না। বিদেশি পর্যটক ফ্রেডরিক বারবোসা কৃষ্ণদেবের ধর্মীয় উদারতা ব্যাখ্যা করে লিখেছেন : “রাজা সবাইকে এতটাই স্বাধীনতা দিয়েছিলেন যে, তাঁর সাম্রাজ্যে যে কেউ আসতে পারত, এখানে থাকতে পারত এবং নিজ নিজ ধর্ম পালন করতে পারত। কেউ তাকে প্রশ্ন করত না যে সে খ্রিস্টান, ইহুদি, মুর নাকি ধর্মহীন ব্যক্তি।”
সব মিলিয়ে রাজা কৃষ্ণদেব ছিলেন একজন পরিপূর্ণ শাসক। দক্ষিণ ভারতের অন্য কোনো শাসকের মধ্যে এমন বহুমুখী প্রতিভা ও গুণের সমন্বয় লক্ষ্য করা যায় না। তাই ঈশ্বরীপ্রসাদ যথার্থই লিখেছেন: “Polite and amiable in private society; wise and far-sighted in council, eloquent and cultured when he listened to literatures, dignified and awe-inspiring in his public lives, Krishna Deva was formidable in war and indeed a jewel among all the princes."
আশা করি আমার ভাই বোনের এই পোস্টটি অনেক ভালো লেগেছে। এর সাথে কৃষ্ণদেব রায় ও তাঁর কৃতিত্ব বিষয়টিও তোমরা বুঝতে পেরেছ। যদি এই পোস্টটি থেকে কিছু উপকার পাও, তাহলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে কখনো ভুলবেন না।