মহাজনপদের যুগে ভারতের অর্থনৈতিক চিত্র, মহাজনপদের যুগে দ্বিতীয় নগরায়ণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি, হস্তশিল্প, কর ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থা, বাণিজ্য - আসল ব্যাখা

মহাজনপদের যুগে ভারতের অর্থনৈতিক চিত্র, মহাজনপদের যুগে দ্বিতীয় নগরায়ণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি, হস্তশিল্প, কর ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থা, বাণিজ্য: আসসালামু আলাইকুম ভাই ও বোনেরা আপনারা কেমন আছেন? আশা করি ভালো আছেন, আমিও আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি, আপনাদের স্বাগতম জানাচ্ছি লাখ পড়া মাইমুনা তে। আমার নাম মাইমুনা, আজকে আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আপনাদের বিভিন্ন জায়গায় লাগতে পারে। 

আমি জানি আপনারা “মহাজনপদের যুগে ভারতের অর্থনৈতিক চিত্র, মহাজনপদের যুগে দ্বিতীয় নগরায়ণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি, হস্তশিল্প, কর ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থা, বাণিজ্য” বিষয়ে ধারণা নিতে অনলাইনে খোজাখুঝি করছেন।আর আপনি এখন একদম সঠিক পোস্ট এ আছেন। এখানে আপনি এই বিষয়টি সম্পর্কে সব ভালো ভাবে জানতে পারবেন। 


মহাজনপদের যুগে ভারতের অর্থনৈতিক চিত্র, মহাজনপদের যুগে দ্বিতীয় নগরায়ণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি, হস্তশিল্প, কর ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থা, বাণিজ্য

মহাজনপদের যুগে ভারতের অর্থনৈতিক চিত্র, মহাজনপদের যুগে দ্বিতীয় নগরায়ণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি, হস্তশিল্প, কর ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থা, বাণিজ্য


মহাজনপদের যুগে অর্থনৈতিক অবস্থা :

বৌদ্ধ পালি সাহিত্য, সংস্কৃত সূত্রসাহিত্য এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে মহাজনপদের যুগে ভারতের অর্থনৈতিক চিত্র সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মূলত পূর্ব-উত্তর প্রদেশ ও বিহারের গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা মহাজনপদগুলির ভূতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের প্রভাব তাদের অর্থনীতিতে স্পষ্ট। মধ্যগঙ্গা উপত্যকার (গঙ্গা-যমুনা দোয়াবসহ নিম্ন গাঙ্গেয় অববাহিকা) প্রায় ৬০,০০০ বর্গ মাইল এলাকার উর্বর মৃত্তিকা এবং সুযম বৃষ্টিপাত এই এলাকাটিকে কৃষি উৎপাদনের লোভনীয় ক্ষেত্রে পরিণত করেছিল। অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশের অত্রজ্ঞিখেড়া, কৌশাম্বী, প্রহ্লাদপুর, রাজঘাট এবং বিহারের পাটনা, সোমপুর, বৈশালী, সোমপুর, চম্পা প্রভৃতি অঞ্চলে বিপুল আকরিক লৌহখনির অস্তিত্ব সমৃদ্ধ অর্থনীতির প্রেক্ষাপট গড়ে দিয়েছে।

মহাজনপদের দ্বিতীয় নগরায়ণ :

প্রত্নতাত্ত্বিক বিচার অনুসারে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে উত্তর ভারতের কৃষ্ণবর্ণ উজ্জ্বল মৃৎপাত্র' (North ern Black Polished ware: NBPW) নির্মাণের সূচনা হয়েছিল। খননকার্য থেকে জানা গেছে যে উজ্জ্বল ধূসরবর্ণ মৃৎপাত্রের (Polished gray ware : PGW) উত্তর ভারতে যে জনবসতি বিশিষ্ট অঞ্চল ছিল, পূর্ববর্তী কালের কৃয়লোহিত বর্ণ মৃৎপাত্রের (Black and red ware) তুলনায় তার পরিধি ছিল তিনগুণ বেশী। কৃয়বর্ণ উজ্জ্বল মৃৎপাত্রের সময়কালে অর্থাৎ‍ খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে জনবসতির পরিধি বেড়ে ছিল তারও প্রায় আড়াইগুণ বেশী। বসতির এলাকা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি হস্তশিল্প এবং কৃষি উৎপাদনও বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এই অগ্রগতি উত্তরপ্রদেশ ও বিহারের গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে নগর সভ্যতার পুনরুত্থান ঘটায়। গাঙ্গেয় উপত্যকায় নগর-সভ্যতা উন্মেষের এটিই প্রথম দৃষ্টান্ত। তবে ভারতের প্রেক্ষিতে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের নগরায়ণকে ‘দ্বিতীয় নগরায়ণ' (Second Ubranisation) বলা হয়।


ভারতবর্ষে প্রথম নগরায়ণ ঘটেছিল হরপ্পা সংস্কৃতির আমলে। হরপ্পা সভ্যতার অবক্ষয়ের সঙ্গে সঙ্গে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ১৯০০ শতকে নগর সভ্যতার ভাঙ্গন শুরু হয়। হরপ্পা সংস্কৃতিৰ চূড়ান্ত পতনের পর, আনুমানিক ১৫০০ খ্রিষ্টপূর্ব থেকে ভারতে নগরের অস্তিত্ব ছিল না। বৈদিক সভ্যতা গ্রামীণ সভ্যতা হিসেবেই প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে চিহ্নিত হয়। বৈদিক সাহিত্যে নগরের উল্লেখ প্রায় নেই। পরবর্তী বৈদিক যুগে নিম্ন দোয়াব ও সন্নিহিত অঞ্চলে সুপ্রসারিত বসতি এলাকার সন্ধান পাওয়া যায়। তবে জনসংখ্যার হার কিংবা বসতি এলাকার আয়তন বিপুল হলেও, এই সকল বসতিতে হস্তশিল্প, মুদ্রা, বাণিজ্য এবং কৃষি উদ্বৃত্তের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মধ্য গাঙ্গেয় সমভূমিতে গড়ে ওঠা বসতিতে এই সকল বৈশিষ্ট্যের অস্তিত্ব ভারতে দ্বিতীয় নগর সভ্যতার আবির্ভাব প্রমাণ করে। পালি সাহিত্যে নগর ও নগর জীবনের স্পষ্ট উল্লেখ পাওয়া যায়।


সাহিত্যসূত্র থেকে এই পর্বে নগরায়ণের আভাস পাওয়া যায়। পানিনি তাঁর ‘অষ্ট্যাধ্যায়ী' গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, গঙ্গা অববাহিকায় নগরগুলি গড়ে উঠেছিল। তিনি গ্রাম ও নগরের বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য সম্পর্কে সচেতন ছিলেন, এর প্রমাণ তাঁর সমস্ত মন্তব্য স্পষ্ট। পালি সাহিত্যে নগর ও নগরজীবনের বিকাশ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। দীর্ঘনিকায়' গ্রন্থে উল্লেখ আছে যে, গৌতমবুদ্ধের আমলে উত্তর ভারতে যাটটি নগরের অস্তিত্ব ছিল। মধ্য গাঙ্গেয় অঞ্চলে কৌশাম্বী, বারাণসী, চম্পা, শ্রাবস্তী, রাজগৃহ, কুশীনগর, খৈরাডিহ প্রভৃতি নগরের উদয় হয়েছিল। মহাজনপদের রাজধানী হিসেবে এই স্থানগুলি জনসমাবেশ, বাণিজ্য, গৃহনির্মাণ, উন্নত পথঘাট, পরিবহণ ইত্যাদির দিক থেকে অগ্রণী ও উন্নত ছিল। যা নগর জীবনের বৈশিষ্ট্যের দ্যোতক। প্রাথমিক পর্যায়ে এই সকল নগরের বস্তুগতমান খুব উন্নত ছিল না। তবে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকের মাঝামাঝি সময়ে উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের অস্তিত্ব পূর্বাপেক্ষা উন্নত জীবনধারার সাক্ষ্য দেয়। ছোট, বড়, মাঝারি নানা মাপের বাড়ি, রাজপ্রাসাদ, প্রশস্ত রাস্তাঘাট, নানা স্তরের প্রশাসনিক কর্মচারী এবং সুদীর্ঘ প্রাকার বিশিষ্ট বসতির উল্লেখ সাহিত্য সূত্রে জানা যায়। বাড়িগুলি সম্ভবত পোড়া ইটের ছিল না, তবে রোদে শুকানো শক্ত ইঁট ব্যবহার করা হত। কাঠের বাড়িও নির্মিত হত। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের আগে বাড়ি নির্মাণে পোড়ানো ইঁটের ব্যবহার দেখা যায় না। পালি সাহিত্যে সাততলা বিশিষ্ট প্রাসাদের উল্লেখ আছে। তবে উৎখনন থেকে এমন সুউচ্চ বাড়ির কোন নিদর্শন পাওয়া যায় নি। প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠা অধিকাংশ নগর ক্রমে বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। শিল্পী-কারিগর ও বণিকদের বসবাস নগরগুলির বহুমুখী ব্যস্ততার কারণ ছিল। ভাগলপুরের সন্নিকটে অবস্থিত চম্পা নগরীকে প্রাকৃত সাহিত্যে 'বেনিয়াগাম' বলা হয়েছে। সম্ভবত বণিকদের বসতি গড়ে ওঠার কারণে এই নামকরণ করা হয়েছে। কোন কোন অঞ্চল কারিগরদের বসতি-কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বৈশালীর সদ্দলপুত্তে প্রায় পাঁচশত মৃৎশিল্পের বিপণী ছিল। এই সকল কারিগর ও ব্যবসায়ীদের পৃথক পৃথক সংঘ বা শ্রেণী (Guild) ছিল, যা নগর সভ্যতার প্রমাণ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ। পালি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, গৌতম বুদ্ধের সময়ে বিভিন্ন ধরনের শিল্পী ও ব্যবসায়ীরা নগরে বাস করত এবং নিজ নিজ পল্লী গড়ে তুলত। তারা সমবায়সংঘ ( Guild) ও 'নিগম' গুলিতে সংগঠিত হত। পালি ভাষায় নগরকে 'নিগম' বলা হত।


গঙ্গা-যমুনা দোয়াব অঞ্চলের অন্যতম দুটি নগর গড়ে উঠেছিল হস্তিনাপুর ও অত্রঞ্জিখেড়াতে। মহাভারতে হস্তিনাপুর বর্ণনা আছে। অত্রভিখেড়াতে বুদ্ধের সমকালে নগর সভ্যতা পূর্ণ রূপ পেয়েছিল। পূর্ববর্তী চিত্রিত ধূসর মৃৎপাত্রের যুগের তুলনায় কৃষ্ণবর্ণ উজ্জ্বল মৃৎপাত্রের আমলে জনবসতির ঘনত্ব ও এলাকা অনেকটা বেড়েছিল। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে বৃহৎ প্রাকার দ্বারা নগরটিকে ঘিরে দেওয়া হয়েছিল, যা নগরের অগ্রগতি নির্দেশ করে। 

বৎস মহাজনপদের রাজধানী কৌশাম্বীর নগরায়ণের প্রাথমিক লক্ষণ খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের আগেই দেখা গিয়েছিল। কারণ এর বৃহদাকার প্রাকারটি তখনই নির্মিত হয়েছিল। নগরের আয়তন বুদ্ধের সময় বৃদ্ধি হয়েছিল ৫০ হেক্টর এলাকা, যা গোটা রাজ্যের মধ্যে বৃহত্তম নগরের মর্যাদা দাবি করে। কারা ও শৃঙ্খবারপুরীতেও নগর সভ্যতার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। গাঙ্গেয় সমভূমিতেও গড়ে ওঠা বারানসী নগরটিও সূচনা খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ট শতকের আগে। মগধের রাজধানী রাজগৃহ অন্যান্য সমকালীন নগরের থেকে বেশী সুরক্ষিত ছিল। এর প্রাকারটি প্রস্তর নির্মিত, যা অন্যত্র ছিল না। গাঙ্গেয় উপত্যকার বাইরে গড়ে ওঠা দুটি বিখ্যাত নগর ছিল গান্ধারের রাজধানী তক্ষশিলা এবং অবস্তির রাজধানী উজ্জয়িনী। এগুলিও সম্ভবত কৃষ্ণবর্ণ উজ্জ্বল মৃৎপাত্র পর্যায়ের বহু আগে আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব সপ্তম শতকের মধ্যে পূর্ণ নাগরিক চরিত্র পরিগ্রহ করেছিল। 

মধ্যপ্রদেশের এরান আলোচ্য পর্বে নাগরিক চরিত্র পেয়েছিল। পাটলিপুত্রকে নগরের সম্ভাবনাপূর্ণ বলে গৌতমবুদ্ধ মন্তব্য করেছেন। অর্থাৎ তাঁর সময় পাটলিপুত্র নগরের মর্যাদা পায়নি। সম্ভবত ব্যস্ত বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পাটলি গ্রামকে গৌতম ‘সম্ভাব্য নগর' বলেছিলেন। পরবর্তীকালে মগধের রাজধানী হলে, তা পূর্ণ নগরের বৈশিষ্ট্য অর্জন করে।


ভারত-ইতিহাসে দ্বিতীয় নগরায়ণের সূচনা ও বিকাশ বাস্তবতঃ প্রথম নগরায়ণের অনুসারী বা উত্তরাধিকারী ছিল না। হরপ্পীয় নগরগুলি ধ্বংস হওয়ার পরবর্তী অন্তত হাজার বছর ভারতে নগর সভ্যতার রেসটুকুও ছিল না। এমনকি হরপ্পা সভ্যতার অবসানের পর এই উপমহাদেশ থেকে পোড়ামাটির ইটও অদৃশ্য হয়ে যায়। ফলে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মধ্য গাঙ্গেয় অঞ্চলে যে নগরায়ণের (দ্বিতীয় নগরায়ণ) সূচনা হয়, তা সম্পূর্ণত নতুন। তাছাড়া হরপ্পা সভ্যতার মত দ্বিতীয় নগরায়ণের সম্পূর্ণ বিলুপ্তি কখনো ঘটেনি। খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের পর অধিকাংশ বৃহৎ নগরের পতন ঘটলেও কিংবা নগরের গুরুত্ব হ্রাস পেলেও, সীমিত আকারে নগরসভ্যতার ধারাবাহিকতা খ্রিষ্টীয় দ্বাদশশতক ও তার পরেও বজায় ছিল।

বৈদিক যুগে গ্রামীণ অর্থনীতি :

কৃষি : নগরায়ণের একটি আবশ্যিক শর্ত হল সমৃদ্ধ গ্রামীণ প্রেক্ষাপট এবং উদ্বৃত্ত উৎপাদন। নগরে প্রধানত রাজা, প্রশাসকবৃন্দ, পেশাদার গোষ্ঠী সমূহ, বণিক, কারিগর ইত্যাদি বসবাস করেন। এঁরা কেউই সরাসরি খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত থাকেন না। নগরকেন্দ্রিক শিল্প, বাণিজ্যের ভিত্তি যত দৃঢ়ই হোক, নগরবাসীকে জীবন ধারণের জন্য গ্রামীণ কৃষি উৎপাদনের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে নগরসভ্যতার পুনঃপ্রতিষ্ঠার সমকালে অবশ্যই উন্নত কৃষি- পশ্চাদ্‌ভূমি ছিল। পালি সাহিত্যে মধ্যগাঙ্গেয় উপত্যকায় প্রসারিত গ্রাম সমাজ ও উন্নত কৃষি অর্থনীতির আভাস পাওয়া যায়। পালি সাহিত্যে বহু গ্রামের উল্লেখ আছে। অসংখ্য ছোট-বড় গ্রামের মধ্যস্থলে নগরের অস্তিত্ব ছিল। মধ্য-গাঙ্গেয় সমভূমিতে গৌতম বুদ্ধের সময়কালে প্রথম জনবসতি গড়ে ওঠে এবং বসতি এলাকার বাইরে তাদের কৃষি জমি ছিল। পালি সাহিত্যে তিন প্রকার গ্রামের উল্লেখ আছে। প্রথম শ্রেণীতে ছিল প্রথাগত ধাঁচের বড় বড় গ্রাম যেখানে নানা জাতি বর্ণ ও বৃত্তির লোক বসবাস করত। এই শ্রেণীর গ্রামের সংখ্যা ছিল সব থেকে বেশী। ‘ভোজক' নামক গ্রাম প্রধান প্রতিটি গ্রামে নেতৃত্ব দিতেন। দ্বিতীয় শ্রেণীতে ছিল নগর ও গ্রামীণ এলাকার মধ্যবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠা শিল্পীকারিগরদের গ্রাম। যেমন বারাণসীর লাগোয়া অঞ্চলে অবস্থিত ছিল কাষ্ঠশিল্পী বা রথকারদের গ্রাম। এই সকল শহরতলীর গ্রাম কৃষি প্রধান প্রথম শ্রেণীর গ্রামের সাথে নগরের সংযোগ গড়ে তুলতে সাহায্য করত। এর বাইরে ছিল তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত প্রত্যন্ত এলাকার জঙ্গল সন্নিহিত অঞ্চলের ছোট ছোট গ্রাম। এখানে বসবাসকারীরা ছিল মূলত অকৃষিজীবী এবং খাদ্য সংগ্রহকারী।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহাজনপদগুলির সংগঠিত রূপ এবং অগ্রগতি উন্নত কৃষি পশ্চাদভূমি ব্যতীত সম্ভব হত না। মহাজনপদগুলির অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ উর্বর মধ্য-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চল নিঃসন্দেহে কৃষি উৎপাদনের আদর্শ স্থান ছিল। হিমবাহ থেকে নেমে আসা একাধিক নদ-নদী, পলিমাটি সমৃদ্ধ ক্ষেত্র কৃষিকর্মের জন্য আদর্শ স্থান ছিল। খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পরবর্তীকালে মধ্য গাঙ্গেয় উপত্যকায় গড়ে ওঠা সুদৃঢ় কৃষি অর্থনীতির কথা সমকালীন বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে বা পাণিনির গ্রন্থে স্বীকার করা হয়েছে।

উর্বর মৃত্তিকা এবং উপযোগী আবহাওয়া ছাড়াও সমৃদ্ধ কৃষি-অর্থনীতির বিকাশের কারণ হিসেবে উন্নততর লৌহ প্রযুক্তির কথা বলা হয়। দামোদর ধর্মানন্দ কেশাম্বী, রামশরণ শর্মা প্রমুখ কৃষি উৎপাদনে লৌহ উপকরণ ব্যবহারের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকার জলা-জঙ্গল পরিষ্কার করার কাজে লৌহ কুড়ুল বিশেষ সহায়ক হয়েছিল। লোহার লাঙ্গল দ্বারা গাঙ্গেয় সমভূমির আঁঠালো মাটিকে কৃষি উপযোগী করে তোলা সহজ হয়েছিল। সিংভূম ও ময়ূরভঞ্জ-এর সঞ্চিত খনিজ লৌহ এই উপকরণ তৈরীতে সাহায্য করে। লৌহ কুড়ুল দ্বারা ঘন জঙ্গল পরিষ্কার করে শক্ত ও লম্বা লৌহ লাঙ্গল দ্বারা ভূমি কর্ষণ করার ফলে জমির উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। নতুন নতুন এলাকায় কৃষিক্ষেত্র তৈরী করে এবং লৌহ লাঙ্গল দ্বারা ভূমি কর্ষণ করার ফলে উদবৃত্ত উৎপাদন সম্ভব হয়। এই গ্রামীণ উদ্‌বৃত্ত উৎপাদন নগর সভ্যতা বিকাশের প্রেক্ষাপট গড়ে দেয়। তবে লৌহ উপকরণের প্রয়োগ কৃষি প্রগতির অন্যতম কারণ ঠিকই, তবে কেবল এই শর্ত দ্বারা স্থায়ী কৃষিজীবী সমাজগঠন বা উদ্বৃত্ত উৎপাদন আহরণ করা সম্ভব নয় বলে গবেষক অমলানন্দ ঘোষ মনে করেন। “The city in Early Historic India' গ্রন্থে তিনি বলেছেন যে, গাঙ্গেয় উপত্যকা অঞ্চলে বনজঙ্গল পরিষ্কার বা ভূমিকর্ষণ করতে লৌহ উপকরণের ব্যবহার আবশ্যিক ছিল না। তাম্র নির্মিত কুঠার বা লাঙ্গল দ্বারাও এ কাজ করা যেত। আবার লৌহ উপকরণ উদ্বৃত্ত কৃষি উৎপাদন কিংবা নগরায়ণের নিশ্চয়তা দেয় না। লক্ষণীয় যে, সমকালে দক্ষিণ ভারতে লৌহ উপকরণের অস্তিত্ব ছিল, অথচ খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের মধ্যে সেখানে উদ্বৃত্ত কৃষিজ উৎপাদন ঘটেনি বা নগরায়ণ হয়নি। তাঁর মতে, এ জন্য চাই যথার্থ সাংগঠনিক ভিত্তি। গাঙ্গেয় উপত্যকায় গড়ে ওঠা মহাজনপদগুলি যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামো গড়েছিল, তা উদ্বৃত্ত উৎপাদন ও উদ্বৃত্ত আহরণের সম্ভাবনা নিশ্চিত করেছিল। দাক্ষিণাত্য এমন রাষ্ট্র ব্যবস্থার অনুপস্থিতি উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের মধ্যে আর্থ-সামাজিক প্রভেদ গড়ে দিয়েছিল।

পালি সাহিত্যে নানা ধরনের কৃযকের (কস্সক) উল্লেখ আছে। মাঝারি ও ছোট কৃষকদের বলা হয়েছে 'কুটুম্বিক'। বিপুল সম্পত্তির অধিকারী ‘গহপতি' নামে অভিহিত হতেন। সম্ভবত খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে জমিতে ব্যক্তি মালিকানার ধারণা সক্রিয় ছিল। সাহিত্য সূত্র থেকে জানা যায় যে, জনৈক ভূস্বামী (গৃহপতি) অনাথ পিণ্ডক একটি ভূখণ্ড ক্রয় করে বুদ্ধকে দান করেছিলেন। অর্থাৎ জমি ক্রয় এবং পরে তা দান করা—এইভাবে দু'বার জমির হস্তান্তর প্রচলিত ছিল। যা ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব ঘটিয়েছিল। সাধারণ ভাবে উৎপাদক শ্রেণী উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ ভূমি রাজস্ব দিতেন। রাষ্ট্র সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত, তৃতীয় কোন মধ্যবর্তীর অস্তিত্ব ছিল না। ব্রাহ্মণ ও বণিকদের গ্রাম দানের রীতি প্রচলিত ছিল। জমির মালিক ছাড়াও কৃষিকাজে দাস শ্রমিক ও কৃষি শ্রমিকদের ব্যবহার করা হত।

পালি সাহিত্যে বিভিন্ন ধরনের ফসল ও কৃষি ক্ষেত্রের উল্লেখ আছে। প্রধান কৃষিজ উৎপাদন ছিল ধান। পালি, প্রাকৃত ও সংস্কৃত সাহিত্যে 'শালি' ধানকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়েছে। ষষ্ঠ শতকের সূচনাকালে জলা জমিতে লাঙ্গল চালিয়ে ধানের বীজ বপন করে চাষ করা হত। বুদ্ধের আমলে ধান রোপণ পদ্ধতি মানুষের করায়ত্ত হয়। এক্ষেত্রে বীজতলায় চারাগাছ উৎপাদন করা হয়। অতঃপর সেই চারাগাছ সযত্নে উৎপাদন করে মূল জমিতে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে গোছা গোছা রোপণ করা হয়। এইভাবে রোপণ পদ্ধতি দ্বারা উন্নত শালি ধান উৎপাদন করা হত। এই ব্যবস্থা এখনও খুবই জনপ্রিয় ও কার্যকরী। ধান ছাড়াও বার্লি, ভুট্টা, আখ, ডাল জাতীয় শস্য সেকালে চাষ করা হত।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক ও পরবর্তীকালের গুরত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান। দুটি ধর্মেই ‘অহিংসা' সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে এবং উভয়ধর্মই নির্বিচার পশু হত্যার বিরোধীতা করেছে। বৌদ্ধ সাহিত্য ‘গোরক্ষা'কে উৎকৃষ্ট কর্ম বলা হয়েছে। বৈদিক যজ্ঞানুষ্ঠানে অসংখ্য পশু বলিদান কৃষি অর্থনীতির পথে অন্তরায় ছিল। 'গোরক্ষা'র আদর্শ প্রচার করে বুদ্ধ সচেতন ভাবেই যাগযজ্ঞে পশু বলিদানের নীরব প্রতিবাদ যেমন করেছেন, তেমনি লৌহ লাঙ্গল চালনার প্রয়োজনে গো-শক্তি সংরক্ষণের বার্তা দিয়েছেন। উত্তরপ্রদেশের অত্রঞ্ঝিখেড়ার প্রত্নক্ষেত্র খনন করে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের পূর্ববর্তী পর্যায়ে যে পরিমাণ পশুর হাড় পাওয়া গেছে, পরবর্তী পর্যায়ে তার পরিমাণ অনেক কম। এটি গোরক্ষা প্রবণতার বৃদ্ধির পরিচায়ক।

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতকের আর্থ-সামাজিক রূপান্তর ভারতের ইতিহাসে একটি দিক নির্দেশিকা রূপে চিহ্নিত হতে পারে। পরবর্তী বৈদিক কালপর্বে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে গ্রামীণ অর্থনীতি এবং তাম্রস্মীয় যুগে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের অর্থনীতির থেকে একটি উন্নত খাদ্য উৎপাদন মুখী অর্থনীতি মধ্য গাঙ্গেয় অববাহিকা অঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল। এই উদ্বৃত্ত উৎপাদন বিশিষ্ট অর্থনীতি খাদ্য উৎপাদক ছাড়াও উৎপাদনের সাথে যুক্ত নয় এমন বহু মানুষ যেমন নগরবাসী, প্রশাসকগোষ্ঠী, বণিক, শিল্পীকারিগর প্রমুখের খাদ্য যোগান সুনিশ্চিত করে। রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনা এযুগেই সৃষ্টি হয়। রাজস্ব শক্তি প্রশাসককে সামরিক শক্তি সংগঠিত করার সুযোগ দেয়। এইভাবে বৃহত্তর রাষ্ট্র গঠনের সম্ভাবনা তৈরী হয়।

বৈদিক যুগে হস্তশিল্প :

মহাজনপদের যুগে কৃষি অর্থনীতি ও নগরায়ণের সাথে যুক্ত ছিল বিভিন্ন ধরনের কারিগরিশিল্প ও হস্তশিল্প অগ্রগতির বিষয়টি। পালি সাহিত্যের বর্ণনা এবং প্রত্ন ক্ষেত্রে উৎখনন থেকে এ বিষয়ে কিছু সুনির্দিষ্ট ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়েছে। আদি বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতেও রজক, রত্নক, চিত্রকর, তন্তুবায়, কুম্ভকার ইত্যাদি নানা কারুশিল্পের ও জীবিকার কথা জানা যায়। এছাড়া শকট নির্মাতা, ধাতুর কারিগর, স্বর্ণকার, সূত্রধর, গজদত্তকার, রেশম কারিগর প্রমুখের অস্তিত্ব ছিল বলে জানা যায়। এর ফলে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকেই দ্রব্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে বিশেষীকরণের সূচনা হয়েছিল।


কারিগরি শিল্পের বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ক্ষেত্রটি ছিল মৃৎপাত্র নির্মাণ। বৌদ্ধ সাহিত্যে কুম্ভকারদের পেশা সম্পর্কে বহু আলোচনা দেখা যায়। পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনের নিরিখে প্রাক্-মৌর্য ভারতে মৃৎপাত্র নির্মাণের বিষয়টিকে ভারতীয় সংস্কৃতির অগ্রগতি এবং বিশিষ্ট পর্যায়ের নির্দেশক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বুদ্ধের সমকালীন সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ মৃৎপাত্রটিকে পুরাতত্ত্বের পরিভাষায়। ‘উত্তর ভারতের উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র' (Northern Black Polished Ware : NBPW) বলা হয়। কারিগরি সুক্ষ্মতা ও সৌন্দর্যের বিচারে এটি পূর্ববর্তী আমলের ধূসর চিত্রিত মৃৎপাত্রের (PGW) তুলনায় অনেক উন্নত ছিল। কুমোরের চাকার সাহায্যে এই উন্নত মৃৎপাত্র তৈরী করা হত। এর উপাদান অর্থাৎ‍ মৃত্তিকা ছিল খুবই উন্নত মানের। এই মৃৎপাত্রগুলি তাদের ঔজ্জ্বল্যের জন্য বিখ্যাত। মৃৎপাত্র নির্মাণের পর সেগুলিকে কাঠকয়লার আগুনে ঝলসে কৃষ্ণবর্ণ করা হত। আগুনে পোড়ানোর পর এদের গায়ে এক ধরনের পালিশ লেপন করে এগুলিকে উজ্জ্বল করে তোলা হত। এই ঔজ্জ্বল্যের কারণেই উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রকে ভারতীয় সংস্কৃতির একটি বিশেষ পর্যায়ের দ্যোতক বলা হয়।

পালি সাহিত্যের বিবরণের ভিত্তিতে মনে করা হয় যে, মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকা ছিল উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র উৎপাদনের মূল কেন্দ্র। অহিচ্ছত্রসহ উত্তর-গাঙ্গেয় উপত্যকার অনেক প্রত্নস্থলে খ্রিষ্টপূর্ব ৬০০-৩০০ অব্দের উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র পাওয়া গেছে। মালব থেকে উজ্জয়িনী পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। অর্থাৎ উত্তর গাঙ্গেয় মালভূমিসহ মালবদেশ এই উন্নত সংস্কৃতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়েছিল। কারিগরি দিক্ থেকে এই মৃৎপাত্রগুলি এত উন্নতমানের ছিল যে, এগুলিকে নিত্য ব্যবহার্য সর্বসাধারণের সাংসারিক তৈজস্ব মনে হয় না। অনুমিত হয় যে, নগরবাসী তথা ধনী ব্যক্তিদের বিলাসব্যসনের উপকরণ হিসেবেই এগুলি ব্যবহৃত হত।

কারিগরি দক্ষতার আর একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল লৌহ উপকরণ নির্মাণ ও ব্যবহার। লৌহ কারিগরি শিল্পে দক্ষতা এযুগে কৃষি উৎপাদনের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসে। যুদ্ধাস্ত্র (তরবারি) নির্মাণের ক্ষেত্রেই এই কারিগরি দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল। মধ্য-গাঙ্গেয় পাললিক সমভূমিতে বনাঞ্চল পরিষ্কার না-করে কৃষির প্রসার সম্ভব ছিল না। তামা, ব্রোঞ্জ বা কাঠের উপকরণ দিয়ে এই কাজ করা যেত না। তাই লৌহ সরঞ্জামের উদ্ভব মহাজনপদের যুগে কৃষি বিস্তারের সহায়ক হয়। লোহার কাস্তে, কোদাল, কুড়াল, লাঙ্গলের ফলা ইত্যাদি উপকরণ ভারতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি সূচিত করে। বৌদ্ধ যুগের সাহিত্যে লোহার লাঙ্গল (ফাল) ব্যবহারের স্পষ্ট উল্লেখ আছে। উৎখনন থেকে একালের মাত্র দুটি ফাল (একটি কৌশাম্বীতে অন্যটি বৈশালী অঞ্চলে) পাওয়া গেছে। প্রথমটি যে উজ্জ্বল কৃয়বর্ণ মৃৎপাত্র পর্যায়ের, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। প্রাপ্ত নিদর্শনের সংখ্যাল্পতার কারণ হল মধ্য-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলের আর্দ্র ও মরচে প্রধান মৃত্তিকা। লাঙ্গলের পাশাপাশি লোহার নিড়ানি ব্যবহার করা হত। পূর্ব উত্তরপ্রদেশের কৌশাম্বী, নোহ, অত্রঞ্জি খেড়া, প্রহ্লাদপুর, রাজঘাট, ম্যাসন এবং বিহারের চিরান্দ, বৈশালী, পাটনা, সোনপুর ও চম্পায় বহু সংখ্যক লৌহ নির্মিত সামগ্রী পাওয়া গেছে। এদের অনেকগুলিই খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ অব্দের পূর্ববর্তী উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র পর্যায়ের সমকালীন।

লৌহ তরবারি নির্মাণের কাজেও কারিগরদের দক্ষতা ছিল। জনপদগুলির অর্ন্তদ্বন্দ্ব এবং বৃহৎ রাজ্যগঠন প্রক্রিয়ার যুগে যুদ্ধবিগ্রহ ছিল নিত্য ঘটনা। লৌহ অস্ত্রাদির যোগান উদ্যোগী রাজ্যগুলিকে ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করেছিল। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস উল্লেখ করেছেন যে, পারসিক সম্রাট দারায়ুসের বাহিনীর ভারতীয় সেনা লোহার ফলাযুক্ত তীর ব্যবহার করেছিল। রাজঘাটে উদ্ধার করা লৌহ উপকরণ পরীক্ষা করে পুরাতাত্ত্বিকরা দেখেছেন যে, মানভূম, সিংভূম ও ময়ূরভঞ্জের লৌহ খনি থেকে প্রাপ্ত লোহা অস্ত্র নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছিল। বস্তুবয়ন ও অলংকার শিল্পেও কারিগরি দক্ষতা মহাজনপদের যুগে দেখা যায়।

বৈদিক যুগে কর ব্যবস্থা :

খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ অব্দে রাষ্ট্র ব্যবস্থার পত্তন এবং শক্তি বৃদ্ধির কেন্দ্রে ছিল বিশাল ও পেশাদার সেনাবাহিনী। গ্রীকবীর আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানের সময় মগধে নন্দ রাজাদের অধীনে ২ লক্ষ পদাতিক, ২০ হাজার অশ্বারোহী, ৬ হাজার হস্তি এবং প্রায় ২ হাজার চার ঘোড়া বিশিষ্ট রথের বিশাল বাহিনী ছিল। উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের রাজ্যগুলিতে রথবাহিনী গুরুত্ব হারালেও, অশ্বারোহী যোদ্ধা, পদাতিক ও হস্তি বাহিনী পোষণ করা হত। রাষ্ট্র পরিচালন ও সেনাবাহিনী পোষণের জন্য জনগণের ওপর কর বা রাজস্ব আরোপ করা আবশ্যিক ছিল।


সেকালে যোদ্ধা শ্রেণী অর্থাৎ ক্ষত্রিয় এবং পুরোহিত শ্রেণী অর্থাৎ ব্রাহ্মণদের কোনরূপ করভার বহন করতে হত না। ফলে রাষ্ট্রের সম্পূর্ণ ব্যয়ভার বহন করতে হত কৃষক, কারিগর ও বণিকদের। বৈদিক যুগে গোষ্ঠী প্রধানকে উপজাতিভুক্তদের বাধ্যতামূলক ভাবে ‘বলি' নামক কর দিতে হত। বুদ্ধের আমলে বলি একটি নিয়মিত কর হিসেবে বহাল থাকে। 

'বলিসাধ্যক' নামক কর্মচারী এই কর আদায়ের দায়িত্ব পান। রাজার প্রতিনিধি এবং গ্রাম প্রধান আলোচনার মাধ্যমে করের হার স্থির করতেন। সাধারণভাবে উৎপাদনের এক-ষষ্ঠাংশ কর হিসেবে দিতে হত। এই সময়ে অঙ্ক-চিহ্নিত মুদ্রার প্রচলন ছিল। তাই নগদে বা উৎপাদিত শষ্যের মাধ্যমে কর দেওয়া যেত। এর পাশাপাশি কৃষকদের রাজার প্রয়োজনে বাধ্যতামূলক শ্রমদান করতে হত। জাতক কাহিনীতে বলা হয়েছে যে, অনেক সময় করভারে অতিষ্ঠ হয়ে কৃষকেরা দেশান্তরী হতে বাধ্য হত।

কারিগর ও ব্যবসায়ীরাও কর ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। কারিগরদের প্রতি মাসে একদিন রাজার প্রয়োজনে শ্রম দিতে হত। বণিক ব্যবসায়ীদের ওপর ছিল বিক্রয়শুল্ক। এই শুল্ক আদায়ের দায়িত্ব ছিল শৌল্কিক (Shulkika) বা শুল্কাধ্যক্ষ নামক কর্মীগোষ্ঠীর উপর।

বৈদিক যুগে বাণিজ্য : গিল্ড

মহাজনপদের যুগে বৃত্তি হিসেবে কৃষির পরে বাণিজ্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। কৃষি কাজের তুলনায় বাণিজ্যকর্ম ছিল কম ঝুঁকি সাপেক্ষ এবং মর্যাদাপূর্ণ। পালি সাহিত্যে বাণিজ্যকে বিশেষ মর্যাদাপূর্ণ বৃত্তি বলা হয়েছে। বিভিন্ন স্তরের বণিক বাণিজ্যকর্মে লিপ্ত ছিলেন। মূলত স্থলপথ ও নদীপথে বাণিজ্য পণ্য যাতায়াত করত। পালি সাহিত্যে সমুদ্র ও সমুদ্রগামী জলযানের উল্লেখ থাকলেও, দূরপাল্লার সমুদ্র বাণিজ্যের সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। পালিসাহিত্যে ছোট ব্যবসায়ীদের বহু উল্লেখ আছে। তুলনায় পরবর্তীকালে জাতকে বর্ণিত বড় ব্যবসায়ী অর্থাৎ ‘শেঠি' (শ্রেষ্ঠী)দের উল্লেখ খুবই কম। বিপুল পুঁজির অধিকারী ‘শেঠি' বণিকদের অস্তিত্ব বুদ্ধের আমলে সীমিত আকারে হলেও ছিল। তবে ছোট ছোট বণিকরা দলবদ্ধভাবে গো-শকট্ ভর্তি পণ্য বাণিজ্য উপলক্ষ্যে নিয়ে দুর দেশে যেতেন, এমন উল্লেখ বৌদ্ধ সাহিত্যে আছে। ব্যবসায়ীরা ৫০০ শত বা আরও বেশী গো-শকটের ক্যারাভ্যান নিয়ে দুর্গম পথে পাড়ি দিতেন বলে বৌদ্ধজাতকে উল্লেখ আছে। নৌ-চালনার প্রয়োজনে তাঁরা সমুদ্রতট অনুসন্ধানে সক্ষম পাখির সাহায্য নিতেন বলে ড. শর্মা উল্লেখ করেছেন। এই সকল বণিকদের নেতাকে বৌদ্ধ সাহিত্যে ‘সার্থবাহ' নামে উল্লেখ করা হয়েছে। সার্থবাহ বণিকের দল পূর্ব সীমান্ত (পূর্বন্ত) থেকে গাড়ি বোঝাই পণ্য নিয়ে পশ্চিম সীমান্তের (অপরান্ত) পাড়ি দিতেন বলে পালি সাহিত্য থেকে জানা যায়। প্রাচীন পালি গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, গৌতম বুদ্ধের আমলে তুলোর ব্যবহার জানা ছিল। তাই অযুমিত হয় সুতীবস্ত্র অন্যতম বাণিজ্য পণ্য ছিল। একই মানের কাচ নির্মিত শৌখিন দ্রব্য, রত্নরাজি, সূক্ষ্ম কারুকার্য খচিত উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র ইত্যাদি বাণিজ্য পণ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পাণিনি তার 'অষ্টাধ্যায়ী'তে গবাদিপশু ও অশ্ব কেনাবেচার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। সমকালে কৃষির গুরুত্ব বৃদ্ধি এবং বাণিজ্যের প্রসার ও রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হওয়ার প্রেক্ষিতে গরু ও অশ্ব বাণিজ্যের জনপ্রিয়তা উপলব্ধি করা যায়। মধ্য-গাঙ্গেয় সমভূমি অঞ্চলে উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের. সূচনা হয়েছিল। সৌখিন ও বিলাস দ্রব্য হিসেবেই এটি গুরুত্বপূর্ণ। এই মৃৎপাত্র আবিষ্কৃত হয়েছে বহু দূরবর্তী অঞ্চলে। যেমন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলের তক্ষশিলা, পাঞ্জাব প্রদেশের বিভিন্ন নগর যেমন, অমৃতসর, লুধিয়ানা, গুরদাসপুর, আম্বালা প্রভৃতি অঞ্চলে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-চতুর্থ অব্দের মৃৎপাত্র প্রচুর নিদর্শন পাওয়া গেছে। উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের এই ছড়িয়ে পড়াকে কোলে বাণিজ্যের অন্যতম দৃষ্টান্ত হিসেবে দেখা যায়। মূলত পুরোহিত, যোদ্ধা ও ধনী পরিবারগুলির বিলাসবহুল জীবনযাত্রার স্বার্থে বাণিজ্য প্রসারতা পেয়েছিল। তবে সেকালে বাণিজ্যে রাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কে সমকালীন সাহিত্যে বিশেষ উল্লেখ নেই।


উৎপাদন ব্যবস্থা ও বাণিজ্য যথেষ্ট সংগঠিত ছিল। সমকালীন সাহিত্য ও লেখমালাতে উৎপাদক সংঘ বা বণিক সংঘের উল্লেখ আছে। এই সকল সংঘকে 'শ্রেণী' বলা হত, যা মধ্যযুগের ইউরোপের গিল্ড (guild) সংগঠনের অনুরূপ। জাতক গ্রন্থে শ্রেণীজাতীয় সংগঠনের উল্লেখ আছে। এই সকল শ্রেণী ছিল জাতিভিত্তিক বা পেশা ভিত্তিক গোষ্ঠী। কারিগররা বংশানুক্রমিক ভাবে হস্তশিল্পে নিয়োজিত হতেন। এক এক শ্রেণীর জন্য এক-একটি বিশেষ এলাকাজুড়ে গড়ে তোলার রীতি ছিল। শ্রেণী সংগঠনের নেতাকে বলা হত ‘জ্যেষ্ঠক' বা ‘জেটঠক' বা ‘প্রমুখ'। বণিকদের শ্রেণী সংগঠনের প্রধানকে বলা হত 'শ্রেষ্ঠী' বা ‘সেটঠি'। অনেক সময় একাধিক বণিক শ্রেণী সমবেতভাবে কোনও ‘মহাশ্রেষ্ঠীর' পরিচালনায় কাজ করত। গৌতম বুদ্ধের আমলে অনাথ পিণ্ডক নামক একজন মহাশ্রেষ্ঠীর নাম পাওয়া যায়। শ্রেণীগুলি ছিল স্বশাসিত এবং নিজ নিজ সদস্যদের অধিকার ও কর্তব্য বিষয়ে সচেতন। শ্রেণী বা গিল্ড নিয়োজিত কর্মচারী ‘থল-নিৰ্য্যামক' সদস্যদের পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয় তত্ত্ববধান করতেন। লক্ষনীয় যে, প্রাচীন ভারতের গিল্ড বা শ্রেণীগুলি আধুনিককালের ব্যাঙ্কের মত কিছু কাজ করত। বণিক সংঘগুলি তাদের সদস্যদের মূলধন যোগান দিত। সুদকে বলা হত ‘বৃদ্ধি’।

বৈদিক যুগে মুদ্রা ব্যবস্থা :

যে-কোনো দেশ, জাতি বা মানবগোষ্ঠীর অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল বিনিময় ব্যবস্থা। বর্তমানকালে ব্যাঙ্কগুলি অর্থব্যবস্থা বা বিনিময়ের কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাচীন ভারতে অবশ্যই এ-ধরনের কোন প্রতিষ্ঠান ছিল না। সেকালে বিনিময়ের দ্বারাই মূলত পণ্য লেনদেন হত। গ্রামগুলি ছিল স্বনির্ভর। সাধারণত গ্রামীণ পরিধির মধ্যেই কামার, কুমোর, চাষী প্রমুখ পণ্য বিনিময়ের মাধ্যমে জীবনযাপন করতেন। বৈদিক যুগে ‘গোধন' বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে জনপ্রিয় ছিল। কালক্রমে উৎপাদনে উদ্বৃত্ত সৃষ্টি হলে বিনিময়প্রথার পরিবর্তন জরুরী হয়ে পড়ে। প্রাচীন ভারতে বিনিময়ের কাজ দু'ভাবে সম্পন্ন হত। 

কারিগরশ্রেণী তাদের পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে পৌঁছে দিতেন এবং বিনিময়ে ভোক্তার উৎপাদন সংগ্রহ করতেন। কিন্তু গৌতম বুদ্ধের আমলে কৃষকের উদ্বৃত্ত উৎপাদন সংগ্রহ করে ব্যবসায়ী শ্রেণীর উদ্ভব ঘটে। ‘জাতক' কাহিনী থেকে জানা যায় যে, শ্রেষ্ঠিনগন উদ্‌বৃত্ত খাদ্যশস্য মজুত করতেন এবং নিজেদের ইচ্ছামত দামে কারিগরদের দ্রব্য কিনে নিতেন। পরে কারিগরশ্রেণী কার্যত খাদ্যের জন্য শ্রেষ্ঠিনদের আনুগত্য মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। প্রাচীন ভারতে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে দ্রব্যের ব্যবহারের পাশাপাশি মুদ্রা বা ধাতুখণ্ড ব্যবহারের আভাষ বৈদিক সাহিত্যে পাওয়া যায়। বৌদ্ধ সাহিত্যে 'নিম্ন', 'শতমান' ইত্যাদি ধাতুখণ্ডের উল্লেখ আছে। তবে পণ্ডিতদের অনুমান প্রাচীন ভারতের মুদ্রা ব্যবহারের ইতিহাসকে গৌতম বুদ্ধের সময়কালের আগে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। যাইহোক, উদ্‌বৃত্ত উৎপাদন ও বৃহত্তর ক্ষেত্রে পণ্য লেনদেনের জন্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে মুদ্রা ব্যবস্থার প্রচলন গুরুত্বপূর্ণ।


ব্যবসা-বাণিজ্যের সাথে পণ্য-বিনিময়ের মাধ্যম বিষয়টি ঘনিষ্ঠ ভাবে সম্পর্কিত। মুদ্রা বিজ্ঞানের আধুনিক বিশ্লেষণ থেকে প্রমাণিত যে মুদ্রার আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বাণিজ্য বৃদ্ধির প্রধানতম শর্ত। একইভাবে বাণিজ্যের পরিধি যখন পাড়া ছেড়ে গ্রামে, গ্রাম ছেড়ে জেলায় এবং একইভাবে ক্রম প্রসারিত অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়, তখন সহজলভ্য, সবার পক্ষে গ্রহণযোগ্য একটি মাধ্যমের প্রয়োজন হয়। বৈদিক যুগের বাণিজ্য চলত মূলত বিনিময় প্রথার মাধ্যমে।


পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য বিচার করে ড. রামশরণ শর্মা বলেছেন যে, আমাদের প্রাপ্ত প্রাচীনতম মুদ্রার কাল গৌতম বুদ্ধের যুগের পূর্ববর্তী নয়। দীর্ঘ অনুসন্ধানের পরেও উত্তরের উজ্জ্বল কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্রের আগেকার কোন মুদ্রা পাওয়া যায়নি। ড. ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় মনে করেন, খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকে উত্তর ভারতে মুদ্রা ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটেছিল। বণিকেরা এই মুদ্রা প্রচলন করেন। মুদ্রাগুলির একপিঠে চন্দ্র, সূর্য, হাতি, ঘোড়া, ফুল, বৃক্ষ ইত্যাদি নক্সার ছাপ দেওয়া হত। তাই এগুলিকে ‘অঙ্ক চিহ্নিত মুদ্রা' (Punch marked coin) বলা হয়। 

তবে কোন ব্যক্তি বা বক্তব্য উৎকীর্ণ ছিল না। দক্ষিণ বিহার ও পূর্ব উত্তরপ্রদেশে এই জাতীয় বহু মুদ্রা পাওয়া গেছে। মুদ্রাগুলি রৌপ্য নির্মিত। উল্লেখ্য যে, এই অঞ্চলে আকরিক রৌপ্য আবিষ্কৃত হয়নি। সম্ভবত মুঙ্গের জেলার পার্বত্য অঞ্চলে কিছু রৌপ্যখনি ছিল, যেখান থেকে রূপা সংগ্রহ করা হত। যাই হোক, পালি সাহিত্যে 'কৰ্যপন’ (কহাপন) নামক মুদ্রার কথা বহু ক্ষেত্রে উল্লেখ আছে। সম্ভবত এই অঙ্ক চিহ্নিত রৌপ্য মুদ্রাই ছিল কর্ষপন। তক্ষশিলায় উৎখনন থেকে প্রাপ্ত মুদ্রা ভাণ্ডার কর্ষপন মুদ্রার প্রাচীনত্ব নিরুপণে সাহায্য করে। তক্ষশিলায় একটি মৃৎপাত্রে ১১৭১টি মুদ্রা পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কিছু মুদ্রায় গ্রীক বীর আলেকজান্ডার ও গান্ধার অঞ্চলের গ্রীক শাসক ফিলিপ-এর নাম ঘোষিত আছে। 

অবশিষ্টগুলি অঙ্ক চিহ্নিত রৌপ্য মুদ্রা। লক্ষণীয় যে, অঙ্ক চিহ্নিত মুদ্রাগুলি গ্রীক মুদ্রার থেকে পুরোনো। তাই প্রত্নতাত্ত্বিকদের অনুমান যে, খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকের শেষ পর্বে চালু হওয়া গ্রীক মুদ্রার থেকেও অঙ্ক চিহ্নিত কর্যপণ মুদ্রাগুলি প্রাচীনতর। তবে মুদ্রার পাশাপাশি দ্রব্য বিনিময় প্রথাও প্রচলিত ছিল। কেননা ভারতের অন্যত্র বিশেষত দাক্ষিণাত্য ও দক্ষিণ ভারতে প্রাক্-মৌর্য আমলে কোন মুদ্রার অস্তিত্ব দেখা যায় না। অথচ উত্তরের উজ্বলবর্ণ কৃষ্ণবর্ণ মৃৎপাত্র, যার কেন্দ্র ছিল মধ্য-গাঙ্গেয় উপত্যকা, প্রাক্-মৌর্য যুগে উত্তর দাক্ষিণাত্যে পাওয়া গেছে। এটি উত্তর ও দক্ষিণের বাণিজ্য সম্পর্কের সাক্ষ্য দেয়। মুদ্রার পরিবর্তে সম্ভবত এই বাণিজ্য বিনিময় প্রথায় চালু ছিল।


হেরোডোটাস লিখেছেন যে, পারস্যের আখামেনীয় সম্রাটরা তাঁদের ভারতীয় প্রদেশ থেকে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ৩০০ তালও সোনা রাজকর হিসেবে পেতেন। এখানে প্রাচীনতম যে মুদ্রাগুলি পাওয়া গেছে সেগুলি আসলে রূপার ছোট ছোট খণ্ড। এগুলিতে তিনটি বিন্দু বা অর্ধচন্দ্রকার দাগ বা কোন প্রতীক থাকত। পরবর্তী পর্যায়ে গোলাকার বা আয়তাকার ধাতুখণ্ড থেকে প্রস্তুত মুদ্ৰা দেখা যায়। পেটানো ধাতুর চাদর থেকে এগুলিকে কিছুটা মাপ করে।

আশা করি আমার ভাই বোনের এই পোস্টটি অনেক ভালো লেগেছে। এর সাথে মহাজনপদের যুগে ভারতের অর্থনৈতিক চিত্র, মহাজনপদের যুগে দ্বিতীয় নগরায়ণ ও গ্রামীণ অর্থনীতি, হস্তশিল্প, কর ব্যবস্থা, মুদ্রা ব্যবস্থা, বাণিজ্য বিষয়টিও তোমরা বুঝতে পেরেছ। যদি এই পোস্টটি থেকে কিছু উপকার পাও, তাহলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে কখনো ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন