সুফি-আন্দোলন : সুফিদর্শনের উদ্ভব, সুফিবাদের প্রভাব, সুফিবাদের ওপর অন্যান্য দর্শন ও সাহিত্যের প্রভাব - আসল ব্যাখা

সুফি-আন্দোলন : সুফিদর্শনের উদ্ভব, সুফিবাদের প্রভাব, সুফিবাদের ওপর অন্যান্য দর্শন ও সাহিত্যের প্রভাব: আসসালামু আলাইকুম ভাই ও বোনেরা আপনারা কেমন আছেন? আশা করি ভালো আছেন, আমিও আপনাদের দোয়ায় ভালো আছি, আপনাদের স্বাগতম জানাচ্ছি লাখ পড়া মাইমুনা তে। আমার নাম মাইমুনা, আজকে আপনাদের জন্য নিয়ে এসেছি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা আপনাদের বিভিন্ন জায়গায় লাগতে পারে। 

আমি জানি আপনারা “সুফি-আন্দোলন : সুফিদর্শনের উদ্ভব, সুফিবাদের প্রভাব, সুফিবাদের ওপর অন্যান্য দর্শন ও সাহিত্যের প্রভাব” বিষয়ে ধারণা নিতে অনলাইনে খোজাখুঝি করছেন।আর আপনি এখন একদম সঠিক পোস্ট এ আছেন। এখানে আপনি এই বিষয়টি সম্পর্কে সব ভালো ভাবে জানতে পারবেন। 

সুফি-আন্দোলন : সুফিদর্শনের উদ্ভব, সুফিবাদের প্রভাব, সুফিবাদের ওপর অন্যান্য দর্শন ও সাহিত্যের প্রভাব - আসল ব্যাখা

সুফি-আন্দোলন : সুফিদর্শনের উদ্ভব, সুফিবাদের প্রভাব, সুফিবাদের ওপর অন্যান্য দর্শন ও সাহিত্যের প্রভাব

সুফি-আন্দোলন :

ইসলামধর্মের সূচনাকাল থেকেই ইসলামের এক শ্রেণির অতীন্দ্রিয়বাদী ও রহস্যবাদী মানুষ ছিলেন। পরবর্তীকালে এঁরা ‘তাায়ুফ' বা 'সুফি' নামে পরিচিত হন। অবশ্য সুফি নামটাই বেশি প্রচারিত হয়েছে। ইউসুফ হুসেন-এর ভাষায়: ইসলামের বক্ষদেশ থেকেই সুফিবাদের জন্ম” (bom in the bosom of Islam)। হজরত মহম্মদ যখন ইসলামের মর্মবাণী প্রচার করেন, তখন একদল জ্ঞানী অথচ কিছুটা নির্বিবাদী ও ভাববাদী মানুষ এই ধর্মের অনুগামী হয়েছিলেন। ফিলিপ হিট্টির ভাষায়, “সুফিবাদ হল ইসলামের অতীন্দ্রিয়বাদী রূপ! এটি কেবল কতকগুলি তত্ত্বের সমাবেশ নয়। সুফিবাদের ভিত্তি হল ধর্ম বিষয়ে কিছু গভীর ভাবনা ও অনুভূতি” (“Sufism is the form which mysticism has taken in Islam. It is not so much a set of doctrines as it is a mode of thinking and feeling in the religious domain. ")'। হিট্টির মতে, মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকে এই মতবাদের উৎস ধর্মীয় সত্য ও ঈশ্বর উপলব্ধির জন্য ব্যক্তির ঐকান্তিক আকুতি, ঈশ্বরের সাথে প্রত্যক্ষ যোগসাধনের ইচ্ছা এবং এ বিষয়ে সাধকের গভীর অভিজ্ঞতা। ‘কোরান' তাঁদের কাছে ছিল পবিত্র ধর্মগ্রন্থ এবং পয়গম্বর ছিলেন 'হজরত মহম্মদ'। কোরানের মর্মবাণী এবং হজরতের জীবনদর্শন থেকেই তাঁরা সত্যাসত্যের শিক্ষা গ্রহণ করেন। কিন্তু ইসলামের নির্দিষ্ট ধর্মপালন পদ্ধতি ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি তাঁদের অনীহা ছিল। বাহ্যিক ধর্মীয় আচরণের পরিবর্তে এই সাধকশ্রেণি সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের (আল্লাহ্) আশীর্বাদ ও করুণা লাভের জন্য ব্যক্তির অন্তরের পবিত্রতার ওপর জোর দেন। মির ভালিউদ্দিন লিখেছেন : “পবিত্র অন্তরের মধ্যেই ঈশ্বরের অধিষ্ঠান সম্ভব” বলে সুফিরা বিশ্বাস করতেন। প্রথম পর্বের প্রখ্যাত সুফি সাধকদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বসরার মহিলা সুফি রাবেয়া (অষ্টম শতক) এবং মনসুর-বিন্ হল্লাজ (দশম শতক)। এঁরা প্রেম ও ভক্তিকে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের প্রধানতম পথ বলে গ্রহণ করেন। তাঁরা প্রচার করেন যে, সর্বভূতেই ঈশ্বরের সাথে মানুষের মিলন সম্ভব। ঈশ্বর ও মানুষ সম্পর্কে তথা স্রষ্টা ও সৃষ্টি সম্পর্কে এই অভেদ ভাবনা গোঁড়াপন্থীদের ক্ষুব্ধ করে। তাই ধর্মদ্রোহিতার অপরাধে মনসুরের প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। সুন্নি ও শিয়া উভয় সম্প্রদায়ই সুফিদের বিরুদ্ধাচরণ করেন। এই বিরূপতা সত্ত্বেও অতীন্দ্রিয়বাদী ধ্যানধারণা জনপ্রিয়তা পেতে থাকে।

সুফিদর্শনের উদ্ভব :

নবম শতক পর্যন্ত সুফিবাদ ছিল একটি অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক চেতনা। নবম শতক থেকে সুফিদর্শন তত্ত্বের উদ্ভব ও প্রচার ঘটে। সুফিদর্শন তত্ত্বের উদ্ভব ঘটে প্রখ্যাত সুফিসাধক হুসেন-বিন্-মুনসুল-এর আমলে (দশম শতক)। তাঁর জীবনধারার মধ্য দিয়ে আত্মার সাথে পরমাত্মার মিলনের তত্ত্ব পরিস্ফুট হয়। পরমাত্মার উপলব্ধির সাথে উপনিষদের ঘোষিত সত্য ‘অহম্ ব্রহ্মাস্মি, অহম্ ব্রহ্মাস্মি বা আমিই ব্রহ্মা'-এর মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই তত্ত্বানুযায়ী বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টির আগে ঈশ্বরই ছিলেন পূর্ণ সত্তা ‘একামেবদ্বিতীয়ম্'। এই ‘একত্ব' থেকে ইহজাগতিক বহুত্বের (multiplicity) আবির্ভাব ঘটে। কে. এন. চিট্‌নিস্-এর ভাষায়: 'The process of creation was marked by the illumination of 'God' in his perfect unity of Love"। হিন্দুদর্শনের সৃষ্টিতত্ত্ব ‘পুরুষ' ও 'প্রকৃতি'র ধারণার সাথে এই ধারণার মিল দেখা যায়।


বিশ্বব্যাপী ইসলামি সাম্রাজ্য সম্প্রসারিত হওয়ার পর ক্ষমতাগরী একদল মুসলমান কোরানের মর্মবাণী ও পয়গম্বরের জীবনাদর্শ থেকে সরে গিয়ে ঐশ্বর্যের স্থূল আড়ম্বরের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং নৈতিক অবনতির শিকার হন। এই বিচ্যুতি ভাববাদীদের প্রতি সাধারণ মানুষকে বেশি করে আকৃষ্ট করে। তবে গোঁড়াপন্থীদের সাথে ভাববাদীদের বিরোধের এই শেষোক্ত ধারার সরল অগ্রগতিকে ব্যাহত করতে থাকে। শেষ পর্যন্ত আরবীয় দার্শনিক আল গজালী (১০৫৭-১১১২ খ্রিঃ) সুফিদের অতীন্দ্রিয়বাদ ও ইসলামের গোঁড়া মতবাদের মধ্যে একটা সমন্বয়সাধনের কাজে কিছুটা সফল হন। তিনি ইসলামের রহস্যবাদকে অধিবিদ্যামূলক ভিত্তি দেন। যুক্তিবাদীদের দর্শনকে নস্যাৎ করে তিনি প্রমাণ করেন যে, কেবল যুক্তিতর্ক দ্বারা ঈশ্বরের মহিমা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ঈশ্বরের প্রকাশের মাধ্যমেই এই জ্ঞানার্জন সম্ভব। কোরান হল ঈশ্বরের বাণী। তাই রহস্যবাদীদের কাছে এই গ্রন্থ অপরিহার্য। তিনি যুক্তি দ্বারা প্রমাণ করেন যে, অতীন্দ্রিয়বাদ ইসলামসম্মত। তাঁর ব্যাখ্যার ফলে সুফিবাদ ইসলামের অন্যতম শাখা হিসেবে অগ্রসর হওয়ার পথ খুঁজে পায়। পরবর্তীকালে দেখা যায়, বহু ক্ষমতাবান শাসক এবং অভিজাত ব্যক্তি সুফিসাধকদের অনুগামী হয়েছিলেন।

সুফিবাদের ওপর অন্যান্য দর্শন ও সাহিত্যের প্রভাব :

ইসলামের বক্ষদেশ থেকে নিঃসৃত সুফিবাদের ওপর সমকালীন ধর্মতত্ত্ব ও সাহিত্যের প্রভাব লক্ষণীয়। প্রাথমিকভাবে খ্রিস্টান ধর্মতত্ত্বের সংস্পর্শে এসে সুফিবাদ নতুন গতিবেগ পায়। খ্রিস্টবাদ দু ভাবে সুফিবাদকে প্রভাবিত করে—বিধিগত ও নৈতিক। বিধিগতভাবে ঈশ্বরের নাম স্মরণ বা প্রার্থনা করা এবং নৈতিকভাবে ইহজাগতিক বিষয়ে অনাশক্তির শিক্ষা দেয় খ্রিস্টবাদ। নবম শতকে গ্রিক সাহিত্যে আরবিতে অনূদিত হলে সুফিবাদ নতুন প্রেরণা পায়। এই নব্য-প্লেটোনিক মতবাদ (New-platonism) তিনভাবে প্রেরণা দেয়। প্রথমত, এটি সুফিদের মধ্যে আত্মনিবেদনের চেতনাকে গভীরতর করে, দ্বিতীয়ত, ঈশ্বরের প্রতি আস্থা গভীরতর করে এবং তৃতীয়ত, সর্বেশ্বরবাদের ধারণাকে পুনরুজীবিত, ও গতিশীল করে।


চূড়ান্ত পর্যায়ে সুফিবাদ বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্মের প্রভাবাধীন হয়। মুসলমান রহস্যবাদী সাধকেরা অজ্ঞাতসারে বৌদ্ধধর্ম ও হিন্দুধর্মের বেশ কিছু দর্শনতত্ত্ব ও আচার গ্রহণ করেন এবং সুফিবাদের সাথে যুক্ত করেন। সুফিবাদের চারটি অঙ্গীকার পবিত্রতা, শুদ্ধতা, সততা ও দারিদ্র্য (cleanliness, purity, truth and poverty) ছিল হিন্দুদর্শনের উপজাত ফল। ভারতীয়দের মতোই সুফিরা ঈশ্বরের (আল্লাহ্) নাম স্মরণ করার সময় জপমালা ব্যবহার শুরু করেন। বৌদ্ধদর্শন থেকেই তাঁরা 'নির্বাণ' (ফানা) এবং আর্য অষ্টাঙ্গ মার্গ (সালুক্) এর ধারণা গ্রহণ করেন। সুফিসাধকদের ধর্মাচরণ পদ্ধতি, যেমন কৃচ্ছসাধন, যোগাসন প্রভৃতির সাথে বৌদ্ধ ও হিন্দু যোগীদের সাধনার মিল লক্ষ্য করা যায়। অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র উল্লেখ করেছেন যে, ইসলামের আবির্ভাবের অনেক আগে থেকেই মধ্য-এশিয়ায় বৌদ্ধধর্ম পরিচিত ছিল। ইসলামের আবির্ভাবের পরেও হিন্দু যোগীরা পশ্চিম এশিয়ায় যেতেন। বুদ্ধের বহু কাহিনি ইসলামের লোকগাথায় প্রচলিত ছিল। 'অমৃতকুণ্ড' নামক যোগসাধনার একটি গ্রন্থ ফারসিতে অনূদিত হয়েছিল। স্বভাবতই বৌদ্ধ ও হিন্দু যোগসাধকদের ধর্মাচরণ-পদ্ধতি সম্পর্কে সুফিরা পরিচিত হয়েছিলেন এবং তাঁদের আচার-অনুষ্ঠানের মধ্যে এগুলির সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন। অধ্যাপক এ. এল. শ্রীবাস্তব মনে করেন, ভারতে প্রবেশ করার পর সুফি ধ্যানধারণার ওপর হিন্দু-ধর্মবিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানের প্রভাব পড়েছিল। আত্মা ও পরমাত্মার সাথে প্রেমিক ও প্রেমিকার সম্পর্কের ধারণা হিন্দুদর্শন থেকেই গৃহীত হয়েছিল। অহিংসা ও শান্তিপূর্ণ জীবনযাপন পদ্ধতির যে আদর্শ ভারতীয় সুফিদের একান্ত পালনীয় কর্তব্যরূপে গণ্য হত, তা বৌদ্ধ, জৈন ও হিন্দুদর্শন থেকে গৃহীত হয়েছিল।

 সুফিদের কঠোর কৃচ্ছসাধন এবং আত্মপীড়নমূলক সাধন পদ্ধতি, যেমন—'চিল্লা' বা নির্জন কক্ষে একান্তে টানা ৪০ দিন ব্যাপী সাধনা, ‘চিল্লা-ই-মা-কুস' অর্থাৎ‍ গাছের ডালে পা বেঁধে মাথা নীচে রেখে ৪০ দিন সাধনা করা ‘পাস-ই-আনপাস' অর্থাৎ ধ্যানে লিপ্ত থাকা ইত্যাদি হিন্দু, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের কাছ থেকে গ্রহণ করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এ ছাড়া হঠযোগীদের সাথে সুফিসাধকদের একটা সুসম্পর্কের ধারা ভারতে বর্তমান ছিল। স্বভাবতই ভারতীয় যোগসাধনার দ্বারা সুফিরা কিছুটা প্রভাবিত হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক রিজভি (S. A. A. Rizzvi ) তাঁর 'Islam in Modern India' গ্রন্থে লিখেছেন, "Various anecdotes indicate that Sufis approved of some ethical values of the yogi's as well of their corporate way of living. " অবশ্য অধ্যাপক সতীশ চন্দ্র মনে করেন যে, এ সম্পর্কে নির্দিষ্টভাবে কোনো সিদ্ধান্ত টানা সম্ভব নয়। তবে সুফিবাদের সাথে বৌদ্ধ ও হিন্দু যোগীদের মত ও পথের যে কিছু সাদৃশ্য ছিল, একথা সত্য।

সুফিবাদের নামকরণ ও সুফিদর্শন :

মুসলিম অতীন্দ্রিয় ও রহস্যবাদীরা কেন ‘'সুফি' নামে পরিচিত হলেন, সে সম্পর্কে একাধিক মত প্রচলিত আছে। কেউ কেউ মনে করেন, 'সাফা' অর্থাৎ ‘পবিত্রতা' শব্দ থেকে 'সুফি' কথাটি এসেছে। এই সকল অতীন্দ্রিয়বাদী সাধক ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে হৃদয়, চিন্তা ও আচরণের পবিত্রতার ওপর জোর দিতেন বলে এঁরা 'সুফি' নামে অভিহিত হন। অনেকের মতে, 'সাফ' বা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো কথাটি থেকে ‘সুফি' শব্দটি এসেছে। আল্লাহ্র কাছে পৌঁছানোর জন্য তাঁর ভক্তমণ্ডলীর যে সাফ বা সারি তার শীর্ষে আছেন এইসব অতীন্দ্রিয়বাদী সাধকগণ। তাই এঁরা 'সুফি' নামে পরিচিত হন। তৃতীয় ব্যাখ্যানুসারে 'সুফা' থেকে 'সুফি' শব্দের উৎপত্তি। এই সকল ভাববাদী সাধক তাঁদের পবিত্র ও ধর্মীয় জীবনের জন্য পয়গম্বর হজরতের অতি বিশ্বস্ত ও নিকটজন 'আসাব-উল্-সুফ'-এর সমকক্ষ ছিলেন। তাই এঁরা 'সুফি' নামে খ্যাত হন। আর একটি মত হল এই সকল অতীন্দ্রিয়বাদী সাধক 'সুফ' বা মোটা উলের পোশাক পরিধান করতেন বলে সুফি নামে সাধারণ্যে পরিচিত হন।




'সুফি' নামকরণের পশ্চাৎপট সম্পর্কে দ্বিমত থাকলেও, সুফিবাদের উৎস ও মতবাদ সম্পর্কে সকলেই একমত। ইসলামের মধ্যে থেকেই সুফিবাদের জন্ম। কোরান সুফিবাদের ভিত্তি। সুফিরা ইসলামের শান্তিদূত। অন্ধকারের দেশ (দার-উল-হার্ব)-কে বিশ্বাসীর দেশে (দার-উল-ইসলাম)-এ পরিণত করাই ছিল তাদের জীবনের ব্রত। অ-মুসলমানকে ইসলামধর্মে দীক্ষিত করার কাজে সুফিগণ যথেষ্ট তৎপর ছিলেন। তবে তাঁদের পথ ছিল শান্তির পথ। মানুষের মনে আল্লাহর প্রতি বিশ্বাসের আসন প্রতিষ্ঠা করে তাঁরা এই কাজ সম্পন্ন করতেন। ইউসুফ হুসেন লিখেছেন : “সুফিবাদ ইসলামধর্মের একটা অংশ, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। তফাত এই যে, গোঁড়া মুসলমানরা ধর্মাচরণের ওপর জোর দেন, কিন্তু সুফিরা গুরুত্ব দেন অন্তরের শুদ্ধতাকে। গোঁড়াপন্থীরা বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বরের করুণালাভের জন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠান নিখুঁতভাবে পালন করা উচিত। কিন্তু সুফিরা মনে করেন, একান্ত প্রেম ও ভালোবাসার মধ্য দিয়েই ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।” প্রখ্যাত মুসলমান ধর্মবিদ, জাকারিয়া আসারীর লেখা থেকে সুফিবাদের মূল আদর্শ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি লিখেছেন : “সুফিবাদ শিক্ষা দেয় অনন্ত শান্তিলাভের জন্য কীভাবে আত্মাকে শুদ্ধ করতে হয়, নৈতিক মান উন্নত করতে হয় এবং ব্যবহারিক জীবনে আচরণ করতে হয়। এর মূল বিষয় হল আত্মার শুদ্ধি এবং প্রধান লক্ষ্য হল স্বর্গীয় আর্শীবাদ লাভ করা।” ইসলামের অগ্রগতির যুগে সুফিসন্তরা শান্তি ও মানবতাবাদের কথা প্রচার করে বিজিত মানবগোষ্ঠীকে ইসলামের প্রতি আগ্রহী করে তোলেন।




সুফিবাদে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে মানুষের মানস-সত্ত্বাকে। এখানে মূলত দুটি প্রশ্নের উত্তর খোঁজার প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। এগুলি হল— (১) মানুষ কীভাবে তার অন্তরে ঈশ্বরকে অনুভব করবে এবং (২) এই সৃষ্টির সাথে ঈশ্বরের সম্পর্ক কী? এই প্রশ্নের উত্তরলাভের জন্য, দুটি পথের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—মার্গ (তরীফৎ)-এর জ্ঞান (মরীফৎ)। মার্গ সাতটি, যথা—সেবা, প্রেম, ত্যাগ, ধ্যান, যোগ, সংযোগ ও সমীকরণ। জ্ঞান হল ঈশ্বরের চেতনাগত উপলব্ধি। জ্ঞান দু-প্রকার—(১) ইলম বা বুদ্ধিনির্ভর জ্ঞান এবং (২) মরীফৎ‍ বা অপরোক্ষ জ্ঞান। সুফিবাদের অধ্যাত্মদর্শন ‘ওয়াদাত-উল্-ওয়াজুদ বা সত্ত্বার ঐক্য (unity of being) ধারণার ওপর প্রতিষ্ঠিত। স্রষ্টা (হক্) এবং সৃষ্টি (খালক্) -এক। এই বিশ্বের দৃশ্যমান বৈচিত্র্য বা বিভিন্নতা একই ঈশ্বরের নানামুখী প্রকাশ। শেখ মহিউদ্দিন ই-এল আরবি সুফিদর্শন ব্যাখ্যা করে লিখেছেন : "There is nothing but God, nothing in existence other than He; there is not even a 'there' where the essence of all things are one." সুফিদের অপর এক গোষ্ঠীস্রষ্টাও সৃষ্টির অদ্বয়তত্ত্বকে কিছুটা সংশোধিত আকারে মান্য করতেন। প্রথমোক্তরা ‘ওজুদীয়া' এবং দ্বিতীয়োক্তরা ‘শুহুদীয়া' নামে খ্যাত হন। ওজুদীয়ারা যখন বলতেন যে, ‘সকলই ঈশ্বরময়' (হাস্য ওসৎ) তখন শাহুদীয়ারা বিশ্বাস করতেন যে, বিশ্বসংসারের সবকিছুই ঈশ্বর থেকে সৃষ্ট (হামা আজ্ব ওসৎ)। ওজুদীয়ারা মরীফৎ বা তত্ত্বজ্ঞানকে শরিয়ত-এর ওপরে স্থান দিয়েছিলেন। স্বভাবতই ঈশ্বরের সাথে মানবাত্মার সরাসরি মিলনের এই তত্ত্ব রক্ষণশীল মুসলমানদের পছন্দ ছিল না। সুফিরা জীব ও ঈশ্বরের এই মিলনতত্ত্ব গ্রহণ করলে রক্ষণশীলরা ক্ষুব্ধ হন। কিন্তু কোনো বিরূপতাই সুফিদের ‘ওয়াদৎ-উল্-ওয়াজুদ' দর্শন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। স্রষ্টার সাথে মিলনের জন্য সুফিরা ঈশ্বরচিন্তায় অবিরাম নিমগ্ন থাকতেন। অতীন্দ্রিয় সাধনার মাধ্যমে ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের আশায় তাঁরা সকল প্রকার জাগতিক সুখ ও ঐশ্বর্য ত্যাগ করে দুঃখকষ্টের মধ্যে জীবনযাপনের পথ বেছে নেন। পাছে সুখ ও ঐশ্বর্য তাঁদের ঈশ্বরবিমুখ করে—এই চিন্তায় সুফিরা সদা শঙ্কিত থাকতেন। এই কারণে পার্থিব শক্তি বা বিষয়াদি থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন থাকাই তাঁদের জীবনদর্শন ছিল। এখানেই হিন্দু অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের সাথে সুফিবাদের মিল।


সুফিদর্শনে ‘পির' গুরুর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঈশ্বরের সাথে আত্মার মিলনের জন্য 'মুরিদ' বা শিষ্যকে পির সঠিক পথ ও পদ্ধতির সন্ধান দেন। পিরের সান্নিধ্য ছাড়া আত্মার সাথে ঈশ্বরের মিলন কিংবা স্বর্গীয় আশীর্বাদ লাভ করা সম্ভব নয়। গুরুর নেতৃত্বে ও প্রদর্শিত পথে অখণ্ড প্রেম ও ভক্তিভাবনা দ্বারা স্রষ্টা ও সৃষ্টির মিলন সম্ভব।


একটি মতানুসারে একজন সুফিসাধনার দশটি স্তর অতিক্রম করলে তবেই ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ করতে পারে। এই স্তরগুলি হল—(ক) তত্তবা বা অনুশোচনা, (খ) ওয়ারা বা নিবৃত্তি, (গ) জুহদ বা ধার্মিকতা, (ঘ) ফ বা দারিদ্র্যের স্বাদ গ্রহণ, (ঙ) সত্র বা সহনশীলতা অর্জন, (চ) শুক্র বা কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন, (ছ) খুফ্ বা অন্যায়ের প্রতি ভীতি, (জ) রজা বা আল্লাহর করুণা লাভের ইচ্ছা, (ঝ) তওয়াস্কুল বা আনন্দে-বিষাদে অচঞ্চল থাকা এবং (ঞ) রিজা বা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করা। ভক্তিবাদী সাধকদের মতো সুফিরাও পার্থিব জগতের সাথে সম্পর্কশূন্য থাকাকে আবশ্যিক মনে করতেন। এটি হল 'তারক্-ই-দুন্যা'। ড. নিজামী (K. A. Nizami) লিখেছেন : “সুফিবাদে সমাজ ও সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাস-জীবনযাপন আবশ্যিক নয়। সমাজ-সংসারের মধ্যে থেকেও পার্থিব চাওয়া পাওয়ার ঊর্ধ্বে থাকাটাই সুফিদর্শনের নির্দেশ। কারণ পার্থিব বিষয়ের প্রতি আসক্তি বৃদ্ধি পেলে অধ্যাত্ম সাধনা বিঘ্নিত হয়।”




সুফিদের একাংশ বিবাহ করে সাধারণ সংসার-জীবনযাপন করতেন। তবে অধিকাংশই গুরু বা পিরের নেতৃত্বে নির্জন স্থানে 'খান্‌ন্কা' বা 'দরগা'য় বসবাস করতেন। এইসব দরগায় পির তাঁর শিষ্যদের ইসলামীয় শাস্ত্রে শিক্ষা দিতেন এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি বিষয়ে দীক্ষা দিতেন। শিক্ষাদীক্ষা ছাড়াও দরগা বা খান্কা দরিদ্রকে অন্নদান ও চিকিৎসার কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত। এঁরা জীবিকানির্বাহের জন্য মূলত নির্ভর করতেন মানুষের অযাচিত দানের ওপর। অবশ্য কেউ কেউ পতিত জমিতে চাষ-আবাদ করতেন। সাধারণভাবে সুফিরা সরকারি কাজকর্মের সাথে যুক্ত থাকা পছন্দ করতেন। সুফি পির ও দরবেশরা কেউ কেউ হিন্দুরাজ্য জয়ের জন্য যুদ্ধ করতেন বলে ড. মজুমদার উল্লেখ করেছেন। সুফিরা প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিলেন। একদল ইসলামী আইনকানুন বা ‘শরা' অনুসরণ করতেন। এঁরা ‘বাশরা’ নামে অভিহিত হন। অপর সংখ্যালঘিষ্ঠ অংশ যে-কোনো ধরনের নিয়মে আবদ্ধ না থেকে মুক্তভাবে অন্তরের বিকাশে আস্থাবান ছিলেন। এঁদের বলা হত ‘বেশরা' গোষ্ঠীই ছিলেন অগ্রণী।

ভারতে সুফিসাধকগণ :

খ্রিস্টীয় অষ্টম শতকে সিন্ধুদেশে আরবদের বিজয়-অভিযানের সময় ভারতে সুফিরা প্রথম প্রবেশ করেছেন বলে মনে করা হয়। সিন্ধু অঞ্চলে তিনশো বছর-ব্যাপী আরব-আধিপত্যের যুগে সুফি-সাধকদের কেউ কেউ ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছিলেন ধরে নেওয়া যেতে পারে। তবে তুর্কিদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবার পর মধ্য-এশিয়া থেকে দলে দলে সুফি ভারতে প্রবেশ করেন এবং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েন। গ্রামপ্রধান ভারতের অভ্যন্তরে দরিদ্র ও শোষিত অ-মুসলমান পাশাপাশি বসবাস করা সুফিদের পক্ষে সহজ হয়। বৈরাগ্য, উদারতা ও সহজ-সরল জীবনযাপন পদ্ধতি দ্বারা এঁরা খুব সহজেই নিম্নশ্রেণির ভারতবাসীর হৃদয় জয় করতে সক্ষম হন। অতঃপর এঁরা অ-মুসলমানদের ইসলামের যুক্তিবাদের প্রতি আগ্রহান্বিত করে ধর্মান্তরিত করার কাজ করতে থাকেন। সুফি-পির ও দরবেশগণ অলৌকিক শক্তি প্রদর্শন করতেন। তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপের প্রতি সাধারণ ভারতবাসীর একটি গভীর টান আগে থেকেই ছিল। এখন সুফিসাধকদের অলৌকিক শক্তির প্রতি সাধারণ মানুষের বিশেষ আকর্ষণ সৃষ্টি হয়। অনেকেই পিরের দরগা'য় নিয়মিত আসতে শুরু করেন। এঁদের অনেকে ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন। লক্ষণীয় যে, হিন্দুরাজার শাসনাধীন অঞ্চলেও সুফিদের অবাধ বিচরণে কোনো বাধা সৃষ্টি করা হত না। ভারতীয় সুফিরা গোঁড়া ধর্মকেন্দ্রগুলির সাথে কোনো যোগাযোগ রাখেননি। রাজনীতি থেকেও দূরে সরে থাকা তাঁদের প্রধান নীতি ছিল। উলেমাদের সঙ্গে স্বভাবতই সুফিদের বিরোধ বাধে। সুফিদের উদার চিন্তা উলেমাদের অপছন্দ ছিল। পক্ষান্তরে সুফিরা মনে করতেন, রাজনীতি ও বিষয়-বৈভবের সাথে উলেমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এবং তা ইসলাম-বিরোধী। আগেই বলা হয়েছে যে, বহু সুফি সমাজেই বসবাস করতেন এবং সংসার করতেন। কিন্তু মন অসন্তোষ থাকলেও রাজতন্ত্র বা উলেমাতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের চিন্তা তাঁদের মনে আদৌ ছিল না। তবে এঁরা মনে করতেন যে, পৃথিবীতে নতুন যুগ আসছে, যখন এক উদ্ধারকর্তা (মাহদী বা মেহ্দী) ইসলামের মর্মবাণী পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবেন।




ভারতে আসার আগেই সুফিদের মধ্যে অসংখ্য 'সিলসিলাহ' বা সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। একটি পরিসংখ্যানে সুফিদের ১৭৫টি 'সিলসিলা'র কথা বলা হয়েছে। আবুল ফজল লিখেছেন যে, ভারতবর্ষে সুফিদের চৌদ্দটি সম্প্রদায় প্রবেশ করেছিল। অবশ্য এদের মধ্যে মাত্র দুটি —–চিতি ও সুরাবর্দী সিলসিলাহ ভারতে প্রভাবশালী ছিল। তবে সুরাবর্দী সম্প্রদায়ের কার্যকলাপ মূলত সীমাবদ্ধ ছিল সিন্ধু ও উত্তর-পশ্চিম ভারতে, কিন্তু চিতি সম্প্রদায়ের প্রভাব সারা ভারতে প্রসারিত হয়। উভয় সম্প্রদায়ই বাশরা অর্থাৎ শরা'র অনুগামী ছিলেন।




ভারতে চিত্তি সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন খাজা মইন্‌উদ্দিন চিশতি (১১৪১-১২৩৫ খ্রিঃ)। ১১৯২ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তিনি শিস্তান থেকে ভারতে আসেন। লাহোর ও দিল্লিতে কিছুদিন অবস্থানের পর আজমিরে চলে যান এবং সেখানেই জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অবস্থান করেন। 

একজন হিন্দু সন্ন্যাসীর মতোই তিনি জীবনযাপন করতেন এবং বেদান্ত দর্শনের মতোই অদ্বৈতবাদ প্রচার করেন। প্রভেদ এই যে, তিনি সৃষ্টিকর্তাকে ‘আল্লাহ্ নামে অভিহিত করেন। আজমিরে মইন্‌উদ্দিনের সমাধি হিন্দু-মুসলমান উভয়ের কাছেই পবিত্র স্থান রূপে গণ্য হয়। খাজা মইন্‌উদ্দিনের শিষ্যদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন শেখ হামিদউদ্দিন, নাগোরি ও কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি। শেখ হামিদউদ্দিনের পিতামাতা ঘুরি আক্রমণের আগেই ভারতে বসবাস শুরু করেছিলেন। শেখ হামিদ অল্প বয়সে মইন্‌উদ্দিনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। রাজস্থানের নাগাউরে তিনি গৃহী জীবনযাপন করতেন। সর্বধর্মের প্রতি ছিল তাঁর সমান শ্রদ্ধা। হিন্দুদের ‘কাফের' বলতে তিনি অস্বীকার করেছিলেন। ধর্মবিদ্ আল- গজালীর লেখার একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি খ্যাতি পান। স্থানীয় হিন্দাবি ভাষায় তিনি সুফিতত্ত্ব প্রচার করতেন। শেখ কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকি ফারগানার উস্-এ জন্মগ্রহণ করেন। ইলতুৎমিসের রাজত্বকালে তিনি ভারতে আসেন। ইলতুৎমিস এই সাধককে রাজপ্রাসাদের সন্নিকটে বসবাসের অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কুতুবউদ্দিন সেই আমন্ত্রণ উপেক্ষা করে শহরের সীমান্তে 'দরগা'য় বসবাস শুরু করেন। সুলতান তাঁকে ‘শেখ-উল্‌-ইসলাম' পদ গ্রহণের জন্যেও অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু শেখ কুতুব তা বিনীতভাবে প্রত্যাখ্যান করেন। তবে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত সুলতানের সাথে মধুর সম্পর্ক বজায় ছিল। অনুমান করা হয়, এই সাধকের স্মৃতিরক্ষার্থে দিল্লির কুতুবমিনার নির্মিত হয়েছিল। উত্তর ভারতে সুফিবাদের বিশিষ্ট প্রচারক ছিলেন শেখ ফরিদউদ্দিন-গঞ্জ-ই শঙ্কর (১১৭৫-১২৬৫ খ্রিঃ)। ‘বাবা ফরিদ' নামেই তিনি বিশেষ পরিচিত ছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি শেখ কুতুবউদ্দিনের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে হাসিতে ‘খান্‌ন্কা' প্রতিষ্ঠা করেন। পরে বর্তমান পাকিস্তানের অযোধান অঞ্চলে স্থায়ীভাবে খান্‌ন্কা স্থাপন করে দর্শন প্রচার শুরু করেন। তাঁর শিষ্যরা একাধিক খান্কা স্থাপন করে সুফিদর্শন প্রচার করতেন। হিন্দু-ভক্তিবাদী সাধকদের সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এত উদার ও উচ্চমার্গের ছিল যে, পরবর্তীকালে শিখদের 'আদি গ্রন্থে' শেখ ফরিদের বহু পদ উদ্ধৃত করা হয়েছে। অযোধানে স্থাপিত শেখ ফরিকদের খান্কা বা জামাইতখানা তাপিত হৃদয়ের তাপমোচনের পুণ্যভূমি রূপে সমস্ত শ্রেণির মানুষের কাছে বন্দিত হয়। এ প্রসঙ্গে নিজামী (K. A. Nizami) লিখেছেনঃ “Jamaat Khana at Ajodhan was one of the great mystic centres of the age, and all shorts of people high and low, rich and poor, flocked to it to soothe their tired nerves in the spiritual atmosphere prevailed there the meassage of Baba Farid still echoes through the corridors of time. "


চিতি সম্প্রদায়ের সর্বাধিক জনপ্রিয় সুফিসাধক ছিলেন বাবা ফরিদের শিষ্য হজরত নিজামউদ্দিন আউলিয়া (১২৩৬-১৩২৫ খ্রিঃ)। তাঁর জন্ম বদাউনে। বাল্যকালেই তিনি পিতৃহারা হন। মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি বাবা ফরিদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। সারা দেশেই নিজামউদ্দিনের খানকা স্থাপিত ছিল। 

তাঁর জীবৎকালে দিল্লির সিংহাসনে সাতজন সুলতান অধিষ্ঠিত হয়েছেন। কিন্তু হজরত নিজামউদ্দিন একবারের জন্যও রাজদরবারে যাননি কিংবা সুলতানের সাহায্য নেননি। সুলতান জালাউদ্দিন খলজি, সুলতান মুবারক শাহ খলজি প্রমুখের একান্ত বাসনা ছিল যে, এই মহান সাধক একবার তাঁদের দরবারে সশরীরে উপস্থিত হন। 

কিন্তু শেখ নিজামউদ্দিন সমস্ত অনুরোধই প্রত্যাখ্যান করেন। সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলক মনে করতেন যে, নিজামউদ্দিন বাংলার স্বাধীনতাকামী শাসক সুলতান নাসিরউদ্দিন খসরু শাহের প্রতি সহানুভূতিশীল। এই কারণে তিনি শেখের প্রতি বিদ্বিষ্ট ছিলেন। সুলতান ঘোষণা করেছিলেন যে, গৌড় অভিযান সমাপ্ত করেই তিনি এই সুফিসন্তকে শাস্তি দেবেন। 

সুলতানের এহেন হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে শেখ নিজামউদ্দিন বলেছিলেন, 'দিল্লি হনুজ দূর অস্ত' অর্থাৎ দিল্লি এখন অনেক দূর। ঘটনাচক্রে এই অভিযান সমাপন করে দিল্লিতে প্রবেশের আগেই সুলতান গিয়াসউদ্দিন মারা যান। এই পরিণতি সুফিসাধকের ঐশীশক্তি ও ভবিতব্য দর্শনের দৃষ্টান্ত হিসেবে জনমনে গভীর রেখাপাত করে। 

যাই হোক, বহু অভিজাত এবং রাজপরিবারের সদস্য ‘পির' হিসেবে তাঁকে গভীর শ্রদ্ধা করতেন। চিতি সম্প্রদায়ের আর এক সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাধক ছিলেন শেখ নাসিরউদ্দিন চিরাগ ই-দিল্লি। নিজামউদ্দিনের পরে দিল্লি খান্কার দায়িত্ব এই মহান শিষ্যের হাতে অর্পিত হয়েছিল। শেখ নাসিরউদ্দিনের বাধাদানের ফলে সুলতান মহম্মদ-বিন্-তুঘলক কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও সুফিদের স্বাধীন ও স্বতন্ত্র জীবনযাপন পদ্ধতি মেনে নিয়েছিলেন। দীনদরিদ্র ও আর্তের সেবা এবং মঙ্গলকামনায় নাসিরউদ্দিনের সারাজীবন অতিবাহিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, এই সম্প্রদায়ভুক্ত সন্ত শেখ সেলিম চিশতি'র একান্ত অনুরাগী ছিলেন প্রখ্যাত মুঘল সম্রাট আকবর।


বাগদাদে সুরাবর্দী সিলসিলাহ'র প্রতিষ্ঠা করেন শেখ শিহাবউদ্দিন সুরাবর্দী। মুলতানের শেখ বাহাউদ্দিন জাকারিয়া আরবদেশে গিয়ে সুরাবর্দীর আদর্শে উদ্বুদ্ধ হন এবং মুলতানে এসে ‘খান্‌কা’ প্রতিষ্ঠা করে সুরাবর্দীর ধর্মদর্শন প্রচার করেন।

 এই সম্প্রদায়ের অন্যান্য প্রখ্যাত সন্ত ছিলেন সদরউদ্দিন আরিফ, সৈয়দ জালালউদ্দিন বুখারী প্রমুখ। সুরাবর্দী সম্প্রদায়ের কার্যকলাপ মূলত পাঞ্জাব ও মুলতান অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল।


চিশতি ও সুরাবর্দী সম্প্রদায়ের জীবনদর্শনে কিছু মৌলিক পার্থক্য লক্ষণীয়। চিশতি সম্প্রদায়ের সত্তরা নির্জন স্থানে খানকা স্থাপন করে গভীর সাধনার পক্ষপাতী ছিলেন। সমাজের হীন, দরিদ্র ও অবহেলিত মানুষের জন্য তাদের সাধনগৃহ সদা উন্মুক্ত ছিল। তাঁদের জীবযাত্রা ছিল সহজ, সরল অথচ কঠোর সংযমপূর্ণ। সংগীত, নৃত্য ও যোগসাধনার মাধ্যমে এঁরা বাণী প্রচার করতেন। এঁদের ভক্তিসংগীত “সমা' খুবই জনপ্রিয় ছিল। 

রাজশক্তি, বিলাস-বৈভব থেকে দূরে থেকে ঈশ্বরের নামগান করাই ছিল এঁদের লক্ষ্য। কিন্তু সুরাবর্দী সম্প্রদায়ের সুফিরা অতিরিক্ত কৃচ্ছসাধন বা পার্থিব জগৎ থেকে দূরে থাকার বিরোধী ছিলেন। এঁরা ধর্মসংক্রান্ত বা বিচারবিভাগীয় উচ্চপদে যুক্ত থেকে ধর্মচর্চা করতেন। স্বভাবতই এঁদের জীবনে বিলাসের অভাব ছিল না। পরন্তু এঁদের যোগাযোগ ছিল কেবল সমাজের উচ্চশ্রেণির সাথে। নিম্নশ্রেণির বা গরিব মানুষ, ফকির প্রমুখ এঁদের খান্কায় প্রবেশাধিকার পেতেন না।


তুলনামূলকভাবে অল্পখ্যাত ও ছোটো সিলসিলাহগুলির মধ্যে কয়েকটি হল–(১) সমরখন্দের শেখ বদরউদ্দিন প্রতিষ্ঠিত 'ফিরদোসী সিলসিলাহ'। 

দিল্লিতে এদের প্রথম প্রকাশ ঘটলেও পরবর্তীকালে বিহার ফিরদোসীদের প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। (২) শেখ মহিউদ্দিন আবদুল কাদের জিলানী প্রতিষ্ঠিত 'কাদেরী সিলসিলাহ'। এই গোষ্ঠীর প্রধান সংগঠক ছিলেন শাহ নিমুতুল্লা কাদের, সৈয়দ মকদুল গিলানী প্রমুখ। এই গোষ্ঠীর আদর্শগত অভ্যন্তরীণ বিরোধ ও মতভেদ এদের প্রসারের কাজকে বারে বারে ব্যাহত করেছিল।


সুফিবাদ এবং ভক্তিবাদের মধ্যে অনেক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন—(১) দুটি মতবাদেই মনে করা হয় যে, সৃষ্টিকর্তা ও তাঁর সৃষ্টির মিলনই মুক্তি বা শান্তির সূচক। এই মিলন সম্ভব। (২) বাহ্যিক আড়ম্বর বা অনুষ্ঠানাদির পরিবর্তে পবিত্র হৃদয়ে ঈশ্বরের প্রতি গভীর প্রেম এবং একান্ত আত্মসমর্পণের পথেই এই মিলন ঘটে। (৩) নামগান, সংগীত, নৃত্য ইত্যাদি ঈশ্বরের প্রতি প্রেমনিবেদনের অতি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। 

(৪) ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভের জন্য পির বা গুরুর নেতৃত্ব আবশ্যিক। একজন গুরুই শিষ্যকে ভক্তিমার্গের সঠিক পথের সন্ধান দিতে সক্ষম। (৫) উভয়ক্ষেত্রেই প্রচারকগণ নিজেরা যেমন অতি সাধারণ জীবনযাপন করতেন, তেমনি তাঁদের অনুগামীদের অধিকাংশই ছিলেন নিম্নবর্ণের মানুষ। শ্রমজীবী ও সমাজে অবহেলিত মানুষের মধ্যে মেলবন্ধনের দূত ছিলেন এঁরা। প্রায় একই সময়ে ভারতে, ধর্মজগতে সুফিবাদী ভক্তিবাদী জাগরণের পরিপ্রেক্ষিতে ঐতিহাসিকেরা মনে করতেন যে, এই দুটি ধারা একে অপরকে প্রভাবিত করেছে এবং পরিণামে প্রভাবিত হয়েছে।

সুফিবাদের প্রভাব :

মধ্যযুগীয় সমাজব্যবস্থা রূপায়ণের ক্ষেত্রে সুফিবাদ একটি সামাজিক শক্তি হিসেবে কাজ করেছিল। সুফিবাদের সহজ-সরল জীবনযাত্রা, চারিত্রিক মাধুর্য ও গভীর নীতিবোধ সাধারণ মানুষকে মুগ্ধ করেছিল। 

তাই কোনো বিশেষ ধর্মীয় সম্প্রদায় নয়, সকল শ্রেণি ও স্তরের মানুষ সুফিবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সামাজিক সাম্য ও সহনশীলতার শিক্ষা নিয়েছিলেন। সুফিবাদের সর্বজনীন আদর্শে উদ্‌বুদ্ধ হয়ে সামাজিক সাম্য ও সহনশীলতার শিক্ষা নিয়েছিলেন। সুফিবাদের সর্বজনীন আদর্শ ধর্মীয় উত্তেজনা প্রশমিত করে হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্ককে সাবলীল করে তুলতে সাহায্য করেছিল। ইসলামের সাম্যবোধ ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের আবেদন সুফিদর্শনের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্পষ্টরূপে প্রকাশ পেয়েছে। 

সুফিদর্শন মুসলিম যুবসম্প্রদায়ের নৈতিক মানোন্নয়ন ঘটাতে সাহায্য করে এবং জীবনকে বাস্তব রূপে দেখাতে সাহায্য করে। সুফিবাদের সাম্যভাবনা খুব সংগত কারণে আকৃষ্ট করে সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষকে। মুসলমানদের পাশাপাশি বহু হিন্দু সুফিসাধকদের অনুরাগীতে পরিণত হন। সুফিসাধকগণ ধর্মান্তরের কথা বললেও তাঁদের জীবন ও দর্শনের আকর্ষণে বহু মানুষ স্বেচ্ছায় ইসলামধর্ম গ্রহণ করেন। হিন্দুধর্মের ওপর সুফিবাদের প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল নগণ্য; কিন্তু হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় সহনশীলতা গড়ে তোলার পক্ষে ও ইতিবাচক সামাজিক পরিবেশ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সুফিবাদের প্রভাব অনস্বীকার্য। সুফিসশুরা ইসলামের ভারতীয়করণ (Indianisation of Islam) করেন। বহু মুসলিম শাসক ও প্রভাবশালী অভিজাত সুফিবাদের সংস্পর্শে এসে অনুভব করেন যে, ধর্মীয় সহনশীলতা ব্যতীত রাজকর্তৃত্ব ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য সুদৃঢ় করা সম্ভব নয়। হয়তো মুঘল সম্রাট আকবরের আমলে এই ধারণা পূর্ণ রূপ পেয়েছিল; তথাপি একথাও সত্য যে, তুর্কি-আফগান শাসনের শেষপর্বে এই সামাজিক প্রক্রিয়ার সূচনা করেছিলেন সুফিসস্তরা।


সুলতানি আমলে সামাজিক সচলতার (social mobility) উপাদান হিসেবে সুফিদর্শনের অবদান স্মরণীয়। সুফিদর্শনের সাম্যভাবনা সামাজিক নিম্নক্রমের মানুষকে উচ্চক্রমে উত্তরণের পথ দেখিয়েছিল। অধ্যাপক সিদ্দিকি (I. H. Siddiqui) দেখিয়েছেন যে, কীভাবে তৎকালীন সমাজে অস্পৃশ্য হিসেবে অপাংক্তেয় সাধারণ মানুষ সুফিসাধকদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে পরবর্তীকালে অসংখ্য মানুষের শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। হিন্দু ও ইসলাম ধর্মের রক্ষণশীল বর্ণ ও জাতিভিত্তিক ভেদাভেদের বিরুদ্ধে এক বিপ্লব ছিল সুফিদর্শন। এই সামাজিক সচলতা পরবর্তীকালে মানব সম্পদের (Human resource) যথার্থ প্রয়োগের পথ খুলে দিয়েছিল।


মধ্যযুগের শিক্ষা ও সাহিত্যের ওপর সুফিদর্শনের ও সুফি-আন্দোলনের প্রভাব ছিল লক্ষণীয়। ‘খান্‌ন্কা' বা 'জমাইতখানা-গুলি বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানান্বেষণের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। প্রত্যহ সমবেত মানুষের কাছে সুফিসম্ভরা জীবনমুখী ধর্ম ও সৃষ্টির অলৌকিক রহস্য ব্যাখ্যা করে তাদের মানসিক বিকাশের সহায়তা করতেন। অনেক খানকায় নিয়মিত বিদ্যালয় পরিচালনা করা হত। সুফিরা হিন্দি ও উর্দুভাষার সমন্বয়ে হিন্দভী ভাষায় কবিতা রচনা করার ফলে তা সাধারণ মানুষের বোধগম্য হয়। ফলে সেই সময় হিন্দি ভাষার শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। সংগীতকেও ঈশ্বর আরাধনার অন্যতম মাধ্যম বলে এঁরা মনে করতেন। সুফিদের গীত বাউলধর্মী 'সম' গান তখন খুবই জনপ্রিয় ছিল। সংগীতও পুষ্ট হয়েছিল। তাই ঐতিহাসিকের ভাষায় বলা যায় যে, সুফিবাদ উভয় সম্প্রদায়ের সামাজিক-সাংস্কৃতিক নেতৃত্বে উদার হৃদয়বেত্তা ও সহনশীলতার বিকাশ ঘটায়, ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বিকাশ ঘটায় এবং উভয় সম্প্রদায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমন্বয়ের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে ("Sufism developed broad mindedness and catholicity of the Social-cultural leadership of both the communities and fostered the feelings of religious tolerence and hastened the process of synthesis between their Socio-cultural traits.")|

আশা করি আমার ভাই বোনের এই পোস্টটি অনেক ভালো লেগেছে। এর সাথে সুফি-আন্দোলন : সুফিদর্শনের উদ্ভব, সুফিবাদের প্রভাব, সুফিবাদের ওপর অন্যান্য দর্শন ও সাহিত্যের প্রভাব বিষয়টিও তোমরা বুঝতে পেরেছ। যদি এই পোস্টটি থেকে কিছু উপকার পাও, তাহলে আপনার বন্ধুদের সাথে শেয়ার করতে কখনো ভুলবেন না।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন